নিঝুম বৃষ্টি

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি। নিরা অবাক হয়ে এই বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টি তার কখনই ভালো লাগেনা। বৃষ্টির শব্দ তার কাছে কেমন যেন সুরহীন মনে হয়। তাল নেই, লয় নেই। মানুষ এই বৃষ্টি এত পছন্দ কিভাবে করে ভেবে পায়না নিরা।
“আচ্ছা, নিহাল কি করত এমন সময়?”, নিরা ভাবে। ঝুম বৃষ্টি নিহালের অনেক প্রিয় ছিল। রাত হোক বা ভোর, বৃষ্টি হলেই সে খালি পায়ে বের হয়ে পড়ত। অনেকদিন নিহালকে এভাবে বৃষ্টির মাঝে খালি পায়ে হেঁটে যেতে দেখেছে নিরা। তার মনে হত ছেলেটা পাগল। কিন্তু এই পাগল ছেলেটাই যে তার জীবনটাকে এভাবে বদলে দেবে কে জানত!
“এই যে নিরা শুনছ?”, পাশের ছাদ থেকে নিহাল ডাক দেয় নিরাকে,,
“জ্বী ভাইয়া।”
“কী কর ছাদে?”
“ভাইয়া এমনিতেই আসলাম,বিকাল বেলা ভালো লাগছিল না।”
“হুম, আজ তোমাকে দেখলাম বারেক কাকার দোকানে। মনে হয় কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলে? তাই না?”
“হ্যাঁ ভাইয়া, মাঝ পথে বৃষ্টি নেমে পড়ল তাই দাঁড়িয়েছিলাম।
”
“তুমি বৃষ্টি ভালবাস না?”
“না ভাইয়া, ভালো লাগে না।”
“ও!”
“ভাইয়া যাই আম্মু ডাকছে।”
“আচ্ছা যাও, তবে বৃষ্টির কিন্তু অন্যরকম একটা আহ্বান আছে যেটা সবাই বুঝতে পারেনা, পারলে ভিজো একদিন। অন্যরকম লাগবে।”
“আচ্ছা ভাইয়া” বললেও মনে মনে পাগল, ছাগল বলে বাসায় চলে আসে নিরা।
.
এরপর অনেকদিন হয়েছে নিহাল প্রায়ই নিরাকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলে, কিন্তু “হ্যাঁ ভাইয়া ভিজব একদিন” “জ্বী ভাইয়া অবশ্যই ভিজব” বলে বারবার এই পাগলটাকে এড়িয়ে যায় নিরা।
সেদিন ছিল আষাঢ়ের প্রথম সন্ধ্যা, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। নিরা বারান্দার জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। “আরেহ ঐটা নিহাল ভাইয়া না”, বৃষ্টিতে প্রায় কাকভেজা নিহালকে দেখে বলে ওঠে নিরা। হুম নিহালই, বৃষ্টিতে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। “আচ্ছা এই পাগল মানুষটার কি আর কোন কাজ নেই?”,ভাবতে ভাবতে চলে যায় নিরা।
.
“নিরা, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল,বলব?”, নিহাল বলে ওঠে নিরাকে। দুজনেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিরাকে অনেক সুন্দর লাগছে যেন বর্ষার স্নিগ্ধতা ওকেও ছুঁয়ে গিয়েছে।
“জ্বী ভাইয়া, বলেন।”, নিরা একদম সাধারণ ভাবেই উত্তর দেয়, তার মাঝে কোন কৌতুহল নেই।
“না মানে, নিরা আমার খুব ইচ্ছে আমি কোন এক বৃষ্টিভেজা রাতে তোমার হাত ধরে হাটব, নিয়ন বাতির নিচে। একটা আলো আধারির খেলার মাঝে আমি আর তুমি অনেক দূর হেঁটে যাব। যখন বৃষ্টি থামবে তখন দেখব দুজনে কাকভেজা হয়ে কোন বিশাল মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে, দুজনে ভোরে সূর্য ওঠা দেখব। যাবে আমার সাথে?”
“নিহাল ভাইয়া, আমি পাগল দেখেছি তবে আপনার মত না। আর একটা কথা আমার সাথে এই ধরনের ফালতু কথা বলবেন না, আসি।”বলে গটগট করে হেঁটে চলে গেল নিরা।
.
“নিরা আপা, নিরা আপা”, খুব ভোরে হাঁপাতে হাঁপাতে আসে কাশেম। নিহাল যেখানে থাকে তার পাশেই এক চায়ের দোকানে কাজ করে সে। নিরাও ওকে চেনে ভালো ভাবেই, মাঝে মাঝেই বাবার জন্য ওদের দোকান থেকে চা আনাতে হয় ওর।
“কি রে কাশেম, কি হয়েছে?”,চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নিরা জিজ্ঞাস করে।
“আপা, নিহাল ভাইতো মইরা গেছে!”
নিরার হাতের চিরুনীটা আস্তে করে মাটিতে পড়ে যায়, কিছু বলতে পারে না ও।
কাশেম বলতে থাকে “কাইল বিয়ানে কাপুইন্না জ্বর আইল, কত কিছু করলাম কিন্তু ভাইয়ের মনে হয় সময় হইয়া আইছিল। মরার আগে আপনারে এইডা দিতে কইল”
নিরার হাতে একটা ছোট্ট চিঠি ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় কাশেম।
প্রিয় নিরা,
তোমাকে সেদিন হুট করে ওভাবে কথাটা বলে ফেলা ঠিক হয়নি। আসলে বুঝতে পারিনি তুমি এত কষ্ট পাবে। আমি আসলে তোমাকে ভালবাসি বলতে চেয়েছিলাম, পারিনি। আসলে পারা হতোও না। খুব ছোটবেলায় নাকি এমনই এক বৃষ্টির রাতে আমার জন্ম, মা জন্মের সময়ই মারা যায়। বাবা আমার জন্য কোনদিন বিয়েও করেন নি। কিন্তু একদিন বাবাও চলে গেল। রয়ে গেলাম শুধু আমি। সেদিন থেকে ঝুম বৃষ্টির মাঝে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াই। মনে হয় এই বৃষ্টির মাঝে কোন এক রাস্তায় তারা আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আর জানোতো ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু মায়ের জন্য যে কান্না পায় খুব। তখন বৃষ্টিতে ভিজি আর চোখের জল ঐ বৃষ্টিতেই ধুয়ে যায়। জানো নিরা আমি তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছি কিন্তু একটা স্বপ্নও সত্যি হবে না আমি জানি। আচ্ছা নিরা তুমি বৃষ্টি কেন ভালবাস না? বৃষ্টির শব্দ শুনেছ কখনও? খুব মন দিয়ে? মনে হয় শোননি, তাইনা? আচ্ছা একটা শেষ কথা, যদি কখনও পারো তবে খুব রাতে ঝুম বৃষ্টিতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে নিয়ন বাতির আলোয় হেঁটে দেখ। অনুভূতিটা না হয় তুমিই জানিও।
ইতি
পাগল নিহাল
.
চিঠি পড়তে পড়তে কখন যে নিরার গাল বেয়ে কান্নার জল বেয়ে পড়া শুরু করেছে তা ও খেয়ালও করেনি। আস্তে করে চিঠিটা ওর ডায়েরীতে রেখে দেয় নিরা...
.
# পরিশিষ্ট:
রাত একটা বাজে, বাইরে ঝুম বৃষ্টি। এত রাতে একলা একটি মেয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। দূরে নিয়ন বাতির আলোয় তার আবছা একটা ছায়া পড়ছে রাস্তায়। আচ্ছা মেয়েটা কি কাঁদছে? নিহালের জন্য? নাকি নিহালের সাথে ওর হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, একসময় ভোর হবে আর ওরা দুজনে ভোর হওয়া দেখবে।