আমি আর রাতুল
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই দেখলাম
আমার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে।
ঢাকার অফিসে আগেই ফোন করে বলে
দেওয়া হয়েছে আমি বাংলাদেশে
আসছি তাই সব কিছু রেডি আছে।হটাৎ
করে আমার দেশে আসাটা
কোম্পানির লোকজন স্বাভাবিক
ভাবে নিচ্ছে না। তাদের ধারণা
অফিসে বড় কোন গোলমাল হয়েছে তাই
আমি দেশে এসেছি।গাড়িতে উঠতেই
ঢাকার অফিস ম্যানেজার আনিস
আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায়
যাবেন স্যার বাসায় ,অফিসে নাকি
হোটেলে? আমি পকেট থেকে একটা
ঠিকানা বের করে তার হাতে দিলাম
সেটার দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার
আনিস ড্রাইভার কে বলল গাড়ি
কুমিল্লা নিয়ে চল।
.
মাথায় না না ধরণের চিন্তা ভির
করছে মানুষ অনেক ছোট জিনিষ ভুলতে
পারে না কিন্তু অনেক বড় বড় জিনিষ খুব
সহজে ভুলে যায় সত্যি মানুষ খুব অদ্ভুত
প্রাণী। নয়ত রাতুল কে কি করে ভুলে
গেলাম আমি? ভাবতেই অবাক লাগে
আমার মস্তিস্ক কি রাতুলের স্মৃতি মুছে
দিয়েছিল কোন কারণে?
.
রাতুলের কথা মনে পরে অনেকটা
হটাৎ!! একদিন স্বপ্নে দেখালাম আমি
একা একা রেল লাইন দিয়ে হাঁটছি।
আচানক আমার পা রেল লাইনের
চিপায় আটকে যায় কিছুতেই ছারাতে
পারছিলাম না। এদিকে ট্রেন চলে
আসছে। তখনি কোথা থেকে রাতুল
এসে আমাকে উদ্ধার করে!!
.
সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
স্বপ্ন থেকে বেশী অবাক হলাম ওর জন্য।
অনেক দিন পরে ওর চেহারাটা
দেখালাম সেই আগের মত আছে আজ
থেকে ৬ বছর আগে যেমন ছিল ঠিক
তেমন। কি আশ্চর্য দীর্ঘ ২ টা বছর ছিলাম
ওর সাথে অথচ ওর সম্পর্কে কিছুই জানি
না শুধু এই টুকু জানি বাড়ি কুমিল্লার
কোথাও। সে দিন ঢাকাতে একজন কে
দায়িত্ব দিলাম ওকে খুজে বের করার
সে ঐ কলেজ থেকে ঠিকানা বের করে
আমাকে ফোন দিয়ে বলল স্যার রাতুল
সাহেবের ঠিকানা পাওয়া গেছে। ঐ
ফোনের ঠিক দুই দিন পরেই নিউইয়র্ক
থেকে বাংলাদেশে চলে আসি।আর
এখন গাড়িতে বসে আছি রাতুলের
কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
.
আমার কলেজ লাইফে আমি, রাতুল ও
রবিন হোস্টেলের এক রুমে থাকতাম।
আমাদের সাবজেক্ট আলাদা থাকলেও
সবাই অনার্স ৩য় বর্ষে পরতাম আমরা।
রাজনীতির কারণে রবিন বছরে ১০ মাস
জেলেই থাকত তাই ধরতে গেলে আমি
আর রাতুলই থাকতাম এক রুমে। ওদের
ভিতরে আমি ছিলাম আর্থিক ভাবে খুব
দুর্বল।
.
আমার জীবনে সবচেয়ে বেশী যেই কষ্ট
করেছি সেটা হল ভাতের কষ্ট। কত
বেলা যে না খেয়ে থেকেছি কেউ
জানে না।ভাতের কষ্ট এমন কষ্ট যে কষ্ট
কেউ অনুভব করতে পারবে না যদি না
সে ভাতের কষ্ট করে। টাকার অভাবে
অনেক সময় রাতে শুধু পানি খেয়ে
ঘুমিয়ে থাকতাম।সেই সময় হোস্টেলের
এক মিল মানে একবেলা খাবারের
দাম ছিল ১২ টাকা সেই টাকাটাই
আমি দিতে পারতাম না। আমার কষ্টের
কথা শুধু মাত্র ২ জন মানুষ জানত রাতুল
আর রান্না ঘরের বাবুর্চি মামা।এই এক
রহস্য সে কি করে জানল আমার আর্থিক
অবস্থার কথা?
.
ও প্রায়ই দেখতাম নানা ধরণের
বিস্কিট এনে আমাকে বলত দেখত কি
বাজে বিস্কিট যে বানায় কোম্পানি
গুলো মুখে দেওয়া যায় না। এই বলে
আমাকে দিয়ে দিত বিস্কিট গুলো
আমি বিষয়টা না বুঝার ভান করে
বলতাম কই দেখি দে। আর যেদিন আমি
দুপুরে খাবার খেতে যেতাম না
সেদিন বাবুর্চি মামা দুপুরের খাবার
শেষে আমাকে এসে বলত বাজান আস
কয়েটা মিল পরে আছে খেয়ে যাও।
অবাক হয়ে ভাবতাম এত শত শত ছাত্রের
মাঝে আমাকে মনে রাখে কি করে
যে আমি আজ খাবার নিতে যাই নি?
.
একবার রাতুলের থেকে এক হাজার
টাকা ধার করেছিলাম ফর্ম ফিলাপের
জন্য। সেই টাকাটা আর ওকে দেওয়া হয়
নাই। আমার কাছে কখন ও সেই টাকাটা
চায় নি আমি সেই সুযোগে এড়িয়ে
গেছি। আপন বলতে কেউ ছিল না
আমার। বাবা-মা যে কবে মারা
গেছে সেটাই ঠিক মত মনে নেই।বড়
হয়েছি একটা এতিম খানায়।ছোট
বেলার স্মৃতি বলতে শুধু এই টুকু মনে
আছে।আমাদের বাড়ির পাশে একটা
রেল লাইন সেই রেল লাইন ধরে ঘণ্টার
পর ঘণ্টা হাঁটতাম আর আর ট্রেন আসলে
লাইন থেকে সরে গিয়ে ট্রেনের
পাশে দৌড়াতাম।দৌড়ে হাপিয়ে
উঠে শুয়ে পরতাম ঘাসের উপরে অবাক
হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে
থাকতাম এক পর্যায় অবাক হয়ে দেখতাম
আকাশটা অনেক নিচে নেমে এসেছে।
.
বাবার চেহারা মনে পরে না মনে
পরে শুধু এক দিন বাবার সাথে নৌকায়
বসে আছি বাবা নৌকা বাইছে আর
আমি হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করছি।
মার চেহারাও মনে নেই মার কথা মনে
হলে মনে পরে কয়েকটা মুরগীর কারণ
মা খুব যত্ন করে মুরগী পালত। মাকে সব
সময় বলতাম “মা তুমি মুরগী কে বেশী
আদর করে খাওয়াও নাকি আমাকে”? মা
হাসত কিছু বলত না শুধু পাগল ছেলে
বলে কপালে একটা চুমু দিত সেই কথা
মনে পরলে এখন ও কপালের সেই
যায়গায় শির শির করে। বাবা-মা
সম্পর্কে এর বেশী কিছু মনে পরে না।
.
মাঝে মাঝে রাতুল বাড়ি থেকে
রান্না করা খাবার নিয়ে আসত বলত
আম্মা রান্না করে দিয়েছে নে
খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে। তখন কোথায়
জানি একটা সুর কেটে যেত মনে হত ইস
আমার যদি এই রকম একটা মা থাকত।
বাড়ি গেলে আদর করে নিজ হাতে
খাবার বেরে দিত। আসলে সব মানুষ সব
পায় না আমি মনে হয় না পাওয়ার।
একবার আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা
করেছিলাম কিন্তু শুধু মাত্র রাতুলের
জন্যই করিনি।
.
হটাৎ করেই একদিন দেখি রাতুল খুব
চুপচাপ হয়ে গেছে কথা বলে না বসে
থাকে ঝিম ধরে।জিজ্ঞেস করে
জানতে পারলাম ওর প্রেমিকার বিয়ে
ঠিক হয়ে গেছে তাই মণ খারাপ।
ভালবাসা কি কখন বুঝতে পারি নাই
আমি। তবে সেদিন বুঝতে পারলাম
ভালবাসা কি যেদিন মাঝ রাতে ঘুম
ভেঙ্গে দেখি রাতুল ওর প্রেমিকা
সালেহার ছবিটা হাতে নিয়ে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে সেদিন
বুঝতে পেরেছি ভালবাসা কি। না ভুল
বললাম আরেক দিন অনুভব করেছিলাম
ভালবাসা কি!!
.
আমি ক্লাসের একটা মেয়েকে অনেক
পছন্দ করতাম কিন্তু সাহস করে কোন দিন
বলা হয়নি তবে মেয়েটা মনে হয় আমার
মনের ভাষা বুঝত কিন্তু সেও কখন ও
আমাকে কিছু বলেনি।একবার কলেজ
থেকে শিক্ষা সফরে যাব। মোটামুটি
আমাদের ক্লাসের সবাই যাচ্ছে।
মেয়েটা ও যাবে আমাকে একদিন
জিজ্ঞেস করে ফেলল এই তুমি শিক্ষা
সফরে যাবে না? কিছু বলতে পারিনি
শুধু বলেছিলাম দেখি এখন ও ঠিক
করিনি। সেদিন নিজেকে খুব অসহায়
মনে হল কারণ যেই পরিমাণ চাদা ধরা
হয়েছে শিক্ষা সফরের জন্য সেই টাকা
দিয়ে আমার এক মাসের খাবার হয়ে
যাবে।
.
একদিন মেয়েটা এসে হাতে একটা কুপন
দিয়ে বলল এই এইটা রাখ তো তোমার
পরিচিত কাউকে দিয়। আমি আমার
বান্ধবির জন্য দিয়ে নিয়েছিলাম এখন
বলছে ও যাবে না তাই শুধু শুধু নষ্ট করে
লাভ নাই।আমি খুব ভাল করেই বুঝতে
পারলাম এই কুপন ও আমার জন্য কিনেছে
তার পরে আমি না বুঝার ভান করে
বললাম আচ্ছা।শিক্ষা সফরে যাওয়ার
দিন মেয়েটা ও আমি পাশা পাশি
বসলাম।সারা রাস্তা আমরা অনেক গল্প
করলাম। মনে হয় আমার ঐ কঠিন জীবনে
সেই দিনটি ছিল সবচেয়ে সুখের।
.
আমি মানুষিক ভাবে প্রস্তুতি
নিচ্ছিলাম মেয়েটাকে সব বলব। একদিন
মেয়েটা আমাকে এসে একটা কার্ড
দিয়ে বলল আমার বিয়ে ঠিক হয়ে
গেছে এস কিন্তু না আসলে কষ্ট পাব।
সেদিন কিছু বলতে পারিনি চুপ করে
তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।ওর চোখের
পানি গাল বেয়ে বেয়ে পড়ছিল চলে
যাওয়ার আগে আমাকে বলল তোমাকে
একটু ছুয়ে দেখি। আমি হাতটা এগিয়ে
দিলাম ও আমার হাত না ধরে বলল থাক
আমি চাই এমন একজন তোমার হাত ধরুক
যে তোমাকে কখন ও ছারবে না।
বিয়েতে আমার আর যাওয়া হয়নি
কারণ গিফট কিনার মত টাকা আমার
কাছে নেই।
.
ঐ দিন অনেক বৃষ্টি হয়েছিল আমি
সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে কান্না
করেছিলাম যাতে কেউ বুঝতে না
পারে।পরে আর ওর সাথে একবার দেখা
হয়েছিল আমার কিন্তু কথা হয়নি কারণ
পাশে স্বামী ছিল। শুনেছি ওর স্বামী
নাকি ওকে নিয়ে ফ্রান্স চলে গেছে।
.
এর ভিতর আমি অ্যামেরিকার একটা
ভার্সিটির স্কলারশিপের জন্য আবেদন
করি। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা
আমাকে স্কলারশিপ দিয়ে দেয়।
আমাকে কিছু করতে হবে না শুধু মাত্র
পাসপোর্ট আর প্ল্যানের ভাড়া
যোগার করতে হবে। গ্রামের বাড়ি
জমি বলতে আমাদের সেই একটা ঘর আর
কিছু নেই।সেই ঘরের দলিল পত্র কোথায়
তাও জানি না পরে গ্রামের এক
মাতাব্বরের কাছে বাড়ি বিক্রি করে
প্ল্যানের ভাড়া যোগার করি।
.
আমি যেদিন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে
যাব সেদিন রাতে রাতুল অনেক ক্ষণ
আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে আর শুধু
একটা কথাই বলেছে আমাকে ভুলে
যাবি না তো?আমি কিছু বলি নি মনে
মনে বলেছি তোকে কি ভুলতে পারি
পাগল।পরের দিন আমার ফ্লাইট ছিল
সকাল
১০.৩০ তে সেদিন আবার রাতুলের
পরীক্ষা ছিল তাই আমাকে
এয়ারপোর্টে দিয়ে যেতে পারে নি।
.
সেই যে দেশ ছারলাম আর দেশে আসা
হয়নি। মনে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসলাম
অ্যামেরিকা এসে সব স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে
গেল। কলেজ শুধু মাত্র আমার
পড়ালেখার খরচ ফ্রি করেছে। আর
খাওয়া থাকা আমার নিজের।অনেক
কষ্টে নাইট ক্লাবে একটা চাকরী
যোগার করলাম রাতে ডিউটি করতাম
আর দিনে কলেজ। বিশ্রাম বলতে কিছুই
ছিল না। দিন যে কোথা দিয়ে পার
হয়ে যায় বুঝে উঠতে পারি না। একটা
চিঠি লিখেছিলাম আমাদের
হোস্টেলের ঠিকানায়। রাতুল সেই
চিঠি পেয়েছে কি না জানি না
কারণ ওর ওখান থেকে আমার কাছে
কোন চিঠি আসে নাই।আর আসবেই কি
করে আমার যে কোন স্থায়ী ঠিকানা
নাই।আর আজ থেকে ৬ বছর আগে
মোবাইলের তেমন প্রচলন ছিল না।
.
গ্রাজুয়েশন শেষে জবের ট্রাই করি
অনেক কিন্তু হয় না কারণ অ্যামেরিকা
এখন অর্থনীতি মন্দার ভিতরে আছে
কোথাও জব নেই উল্টো আরও লোক
ছাটাই করছে কোম্পানি গুলো। পরে
আরেক বাংলাদেশীর সাথে মিলে
ব্যাবসা শুরু করি সেই থেকে আর
পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি খুব অল্প
সময় আমার অবস্থার পরিবর্তন হয়।
.
অতীতের সব ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু
ঐ রেল লাইনের স্বপ্নটা আবার আমাকে
মনে করে দেয় রাতুলকে।চাইলে আগে
থেকে ওকে খবর দিয়ে যেতে পারতাম
সেটা করি নাই দেখতে চাই ও
আমাকে হটাৎ দেখে কি করে?
.
এখন আমি রঙচটা হীন টিনের বাড়িটার
বাইরে দাড়িয়ে আছি ঢুকতে এক ধরণের
সংকোচ লাগছে আমাকে চিনতে
পারবে তো? আমি জোর গলায়
জিজ্ঞেস করলাম বাড়িতে কেউ
আছে? রাতুলের সেই চিরচেনা কণ্ঠ
ভেসে আসল “কে? আসেন ভিতরে
আসেন”। বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকে
দেখালাম ও উঠানের এক কোনায়
একটা মাদুলের উপর বসে আছে। ওর
পায়ের কাছে একটা বাচ্চা বসে
খেলা করছে আর পাশে রাখা ওর ক্রাচ।
.
আমি নিউইয়র্ক থাকতেই সব খবর
নিয়েছিলাম আমি যাওয়ার ২ বছর পরে
নাকি এক রোড এক্সিডেন্টে ওর একটি
পা কেটে ফেলতে হয়েছে। দূর থেকে
যতটা না কষ্ট পেয়েছি তার থেকে
এখন বেশী কষ্ট লাগছে ওকে অসহায়ের
মত বসে থাকতে দেখে।রান্না ঘর
থেকে ওর বউ উকি দিল। বাচ্চাটা
খেলা ফেলে আমার দিকে অবাক
নয়নে তাকিয়ে আছে।
.
ও খুব স্বাভাবিক গলায় বলল ও তুই!! এতদিন
পরে কি মনে করে আসলি?আমি ওর
পাশে গিয়ে বসলাম বললাম তোর সেই
১ হাজার টাকা ফিরত দিতে এসেছি।
ও আমার কথা শুনে উচ্চ সরে হাসতে
লাগল যেন আমি খুব মজার কথা বলে
ফেলেছি। তার পরে বউ কে ডেকে বলল
সালেহা এই হল আমার সেই বন্ধু যে
আমাকে ছেড়ে বিদেশ চলে
গিয়েছিল।আমার দিকে ফিরে বলল
আর ও হল আমার বউ সালেহা তোর তো
চিনার কথা। আমি বেশ অবাক হলাম ও
আমার মনের কথা বুঝতে পারল।
.
তুইত জানতি ওর বিয়ে হয়ে গেছে সেই
সময় কিন্তু ওর বিয়েটা বেশী দিন
টিকে নাইরে। বিয়ে মাস ৬ পরে ওর
স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।
আর এই দিকে অনার্স শেষ করার পরে
একদিন রোড এক্সিডেন্টে আমি আমার
পা হারাই। তার পরে আমার মত পঙ্গু
ছেলে কে মেয়ে দিবে কে? তখন
সালেহা আমাকে বিয়ে করতে রাজি
হয় ওর ফ্যামিলি অমত করে না কারণ
গ্রামে সাধারণত বিধবা মেয়ের
বিয়ে হয় না।
.
এইটা হল আমার পা হারানোর ভাল
দিক যদি পা থাকত তাহলে আমার
ফ্যামিলি রাজি হত না। আর খারাপ
দিক কি জানিস? আমি দুর্বল ভাবে
মাথা নাড়ি না জানি না তখন ও বলে
বাচ্চাটাকে কোলে নিতে পারি
নারে এইটা খুব খারাপ দিক। একবার
যদি ওকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে
পারতাম তাহলেই জীবন স্বার্থক হতরে।
.
এই বলে অন্যদিকে ফিরে চোখের
পানি মুছল।এক ফাঁকে ওর স্ত্রী এসে
বাচ্চা কে নিয়ে গেল ভিতরে আমার
আমাকে ফিস ফিস করে বলল কিছু মনে
করবেন না ওর মাথা ঠিক নাই
সারাদিন বাড়িতে থাকে তো তাই
কথা বেশী বলে।
.
রাতুল বলল চল তোকে একটা জিনিষ
দেখাই এই বলে ও অনেক কষ্টে ক্রাচে
ভর দিয়ে হাঁটতে লাগল।কিছু দূর
যাওয়ার পরে একটা কবর স্থানের পাশে
থেমে হাত তুলে মুনাজাত ধরল আমিও
ওর সাথে মুনাজাত ধরলাম।মুনাজাত
শেষে বলল বলত এটা কার কবর? আমি না
সূচক মাথা নাড়লাম। তার পরে একটু রহস্য
ময় ভাবে মাথা নেড়ে ও বলল তোর
পরিচিত আমার বাবার কবর পাশেরটা
মার কবর। আমি বললাম তোর বাবাকে
কখন ও আমি দেখি নাই পরিচিত হল কি
করে?
.
ও যা বলল তাতে খুব ভাল মত ধাক্কা
খেলাম। ঐ হোস্টেলের বাবুর্চি মামাই
নাকি ওর বাবা ছিল।বাবা ছাত্র
অবস্থায় ওকে ওর পরিচয় গোপন রাখতে
বলেছিল।ওর বাবা চাইত না কেউ
জানুক তার ছেলের পিতা একজন
বাবুর্চি যাকে তরকারিতে একটু লবণ কম
বেশী হলে গালি দেওয়া হয়। এখন
বুঝতে পারলাম আমার না খেয়ে
থাকাটা কি ভাবে জানতে
পেরেছিল সে।
.
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তখন আমার
বাবার কথা মনে পরল বাবা নৌকা
বাইছে আর আমি হাত দিয়ে পানি
স্পর্শ করছি আমি কিছুটা পানি হাতে
নিয়ে বাবার দিকে ছুড়ে মারছি আর
বাবার চেহারাটা ঠিক রাতুলের
বাবার মত। এবার আমি অন্য দিকে
ফিরে চোখের পানি মুছলাম।আচ্ছা সব
বাবারাই কি এক রকম হয়?
.
ওকে জিজ্ঞেস করলাম তুই কি প্রতিদিন
এইভাবে দোয়া করিস? ও বলল ৫ ওয়াক্ত
নামাজ শেষে চেষ্টা করি কবরের
কাছে এসে দোয়া করতে কিন্তু
শরীরে কুলায় না তাই দূর থেকেই করি।
আমার মনে পরল হাদিসে আছে
মানুষের মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার
আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি
আমল জারি থাকে তার ভিতরে একটা
হল “নেক্কার সন্তান যে দোয়া
করবে।“ সত্যি রাতুলের বাবা-মা খুব
ভাগ্যবান যে এই রকম সন্তান রেখে
গেছে পৃথিবীতে।
.
জিজ্ঞেস করলাম তোর সংসার চলে
কিভাবে।বলল যেই জমি-জমা আছে তা
বর্গা দিয়ে বছরের ভাতের ব্যাবস্থা
হয়ে যায় উঠে।আর গ্রামের পোস্ট
অফিসে একটা চাকরী করি সেখান
থেকে মাসের বাজার খরচ চলে যায়
কোন রকমে। চাকরী তো শুধু নামেই এখন
কি আর কেউ চিঠি পোস্ট করে সব
ইন্টার নেটের যুগ। তাই কাজ ছাড়া ঘরে
বসেই বেতন পাই কোন কাজ নাই। আরও
বলল তোকে আমি একটা চিঠি
পাঠিয়ে ছিলাম পেয়েছিলি?আমি
কিছু বললাম না উদাস ভাবে অন্য
দিকে তাকিয়ে রইলাম। খুব ক্ষীণ সরে
বললাম..
.
-- দোস্ত তুই কি আমার উপরে রাগ
করেছিস?
-- দূর পাগল রাগ করব কেন?
-- এই যে এত দিন তোর কোন খোঁজ নেই
নি তাই।
-- তাতে কি এখন তো নিলি।বাদদে ঐ
সব কথা, তোর অবস্থা বল।
-- তোর পাশে আছি আমি এটাই আমার
অবস্থা। আমার সাথে যাবি?
-- কোথায়?
-- অ্যামেরিকা।
-- নারে।
-- কেন?
-- বাবা-মার কবর রেখে কোথাও
যেতে পারব নারে।
-- অহ।দোস্ত আমি যাইরে।
-- সে কি এত দিন পরে এলি এখনি চলে
যাবি?
-- খুব জরুরি একটা কাজের কথা মনে পরছ
তাই যাচ্ছি খুব শিগ্রি আবার আসব।
.
এই বলে আমি এর পিছনে না তাকিয়ে
দ্রুত হাটা দিলাম।বড় রাস্তায় আমার
জন্য গাড়ি ড্রাইভার আর ম্যানেজার
অপেক্ষা করছে।এই দুপুরে কোথায়
জানি মায়াবি শুরে একটা ঘুঘু ডাকছে।
এই মুহূর্তে আমার সব চেয়ে জরুরি কাজ
হল ওর জন্য একটা কৃত্রিম পায়ের
ব্যাবস্থা করা যাতে ওর বাচ্চাকে
কোলে নিয়ে হাঁটতে পারে।
.
২ মাস পরের কথা কার্বন ফাইবারের এই
কৃত্রিম পাটা খুব ভাব ভাবে সেট
হয়েছে ওর পায়ে।প্রথম হাঁটতে একটু
সমস্যা হত এখন নাকি অভ্যাস হয়ে
গেছে।আমি নিজে ওকে দেশের
বাহিরে নিয়ে গিয়ে এই কৃত্রিম পা
লাগিয়ে এনেছি।এখন আর হাঁটতে
ক্রাচ লাগে না মেয়েকে কাঁধে করে
নাকি হাঁটতে পারে।
.
সারাদিন কাজ শেষে ফেসবুকে বসি
শুধু মাত্র রাতুল আর তার মেয়ের ছবি
দেখার জন্য।বাপ-মেয়ে মিলে
সারাদিন ছবি তোলে আর আমাকে
সেন্ড করে। সেদিন নাকি মেয়ে কে
নিয়ে হাটে গেছে সেখান থেকে
মাটির হাঁড়ি পাতিল কিনে এনেছে।
ওকে কোন ভাবেই রাজি করতে পারি
নাই অ্যামেরিকা স্থায়ী ভাবে
আসার জন্য। পরে আমার চাপে পরে
স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে সামনের
তুষার পাতের সময় নাকি আসবে
বেড়াতে আমি সেই আশায় আছি।
.
জানি না রাতুলের ঋণ শোধ হবে
কিনা। না হলে নাই কিছু মানুষের ঋণ
কখন ও শোধ করা ঠিক না তাদের কাছে
ঋণী থাকাই ভাল।আমি না হয় রইলাম ওর
কাছে ঋণী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন