বেঁচে আছো তবে তুমি?
.
দশ টাকা দামের একটি ব্ল্যাক
ব্রান্ডের সিগারেট খেতে খেতে
হেলেদুলে হাটছিলাম রেললাইনের
মাঝখান দিয়ে কেননা সিগারেট এর
ধোঁয়ায় অন্তরের কষ্ট মুছে যায়।এমন
সময় কারো কথা শুনে পিছনে
তাকিয়ে দেখি নাফিসা আর তার
বান্ধবী তানজিনা দাঁড়িয়ে আছে।
আমি তাদের দেখে সম্বিৎ ফিরে
পেয়ে আবার হাটা শুরু করতেই
নাফিসা আমার হাত ধরে আটকালো
আর বললো,
"এরুম ভাব হিকছো কইত্তে।"
.
এই কথা শুনে আমার খুব হাসি
পাচ্ছিলো।কিন্তু মুখটা গম্ভীর করে
নাফিসার দিকে তাকালাম কিন্তু
কিছুই বললাম না দেখে সে আবার
বললো,
.
"পুরোদস্তর দেবদাস হয়ে গেছো
দেখি,মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি,চোখ
কোটরে,চোখের নিচে কালি,হাতে
সিগারেট। বাহ!তোমার এত উন্নতি
ফারাহ?"
.
আমি নাফিসার কথায় কান না দিয়ে
বললাম,
.
" হাত ছাড়ো মানুষ দেখছে।
তোমাকে খারাপ বলবে আর আমার
সাথে এভাবে তোমাকে কেউ দেখে
ফেললে তোমার ইজ্জত চলে যাবে।"
.
"হইছে আমার ইজ্জত নিয়ে তোমাকে
চিন্তা করতে হবে নাহ।খুব চিন্তা
করো তুমি আমাকে নিয়ে। এইজন্য
আমি বিরাট খুশিত। তাই তোমাকে
পুরস্কার দিবো।"
.
নাফিসার ফাইজলামি কথা শুনে
আমার খুব রাগ উঠতেছিলো তাই কিছু
না বলে চুপ করে থাকলাম।
.
"তুমি দেখি বিরাট হিরোর মত ভাব
নিচ্ছো।এত ভাব নিচ্ছো কেন?
আমাকে দেখেই পালিয়ে যাও
কেনো?এত পার্ট নেয়া কই শিখছো?"
.
নাফিসার এই কথা শুনে আমি অবাক
হলাম।কই আমি ওরে কথা শুনাবো
উল্টো সে আমাকে কথা শুনাচ্ছে।
তার দোষ আর আমাকে ঝাড়ি দিচ্ছে।
তাই বললাম,
.
"ভাব নিচ্ছি আমি?ভালোই বলছো
নাফিসা।হ্যা তুমি মেয়ে তুমি সব
বলতে পারবা অবশ্যই।মেয়েদের প্রতি
ছেলেরা দুর্বল স্বভাবতই তাই বলে যা
খুশি তাই বলবে যা খুশি তাই করবে?
একবার ইচ্ছে হলে ঘরে তুলবে
আরেকবার ইচ্ছে হবে ঘর থেকে বের
করে দিবে।আমি কি পুতুল?আমি কি
বস্তু, নির্জীব কি আমি যে যা ইচ্ছা
তাই বলবে কোনো কিছুই মনে করবে
না।"
.
"আমি তোমাকে কবে ঘরে তুললাম?
তোমাকে ঘরে তুললে লোকে বাজে
কথা বলবে না?"
.
এই কথা বলে নাফিসা আর তানজিনা
হাসতে থাকলো।আমিও হাত ছড়িয়ে
চলে আসতে নিয়েছি। এবার হাত ধরে
নি আমার সামনে দাঁড়ায় দৌড়ে
এসে।আর বলে,
.
"কি হলো তুমি চলে যাচ্ছো কেন?
আমার কথা কি শেষ হয়ে গিয়েছি
নাকি হু?আরেক পা বাড়াও তোমার
খবর আছে বলে দিলাম।"
.
আমি কিছু না বলে নাফিসার দিকে
তাকালাম স্থির দৃষ্টিতে।তার মুখের
দিকে তাকালে ঘোর লেগে যায়
তাই গলার তিলের দিকে তাকিয়ে
থাকলাম।এই তিলটা আমার পছন্দের
ছিলো।কারন অনেক অদ্ভুত রকমের
তিল নাফিসার।নাফিসাকে ভালো
লাগার মধ্যে এই তিলের ভালো
লাগাটাও ছিল যদিও এখন নাই।
এক মাস আগে আমার আর নাফিসার
মধ্যে প্রচন্ড রকমের ঝগড়া হয়।আর
সেসময় আমার কোনো কথা না শুনে
ইচ্ছে মত আমাকে কথা শুনিয়ে ফোন
দিতে নিষেধ করছিলো আর আমার
মুখ তাকে দেখাইতে না করেছিলো।
আমি বুঝতে পারি নাই কি থেকে কি
হলো।আমাকে এত কিছু বললো তবে
ঠিক আছে আমিও মেনে নিলাম।ও
আমার কথা না শুনে এসব বলতে
পারছে আমিও যাবো না,দেখাবো
না আমার মুখ তাকে।তাই একমাস
আমি সম্পূর্ণরুপে নাফিসাকে এড়িয়ে
চলেছি।আমার মুখ তাকে না
দেখাইতে খুব চেষ্টা করছি। ভূলে যদি
সামনে পড়ে গেছি তবে নিজেকে
দ্রুত সরিয়ে নিয়েছি।
.
উফফফফফ!ঘোর ভেঙে গেলো আমার।
হাতে তাকিয়ে দেখি আমার হাত
কুনুইয়ের এইখানে লাল হয়ে আছে।
ব্যথায় হাত ককিয়ে উঠে আর
নাফিসার হাত ওইখানে।তার মানে
আমার ব্যথার কারন নাফিসা
আমাকে চিমটি মেরেছে।
.
.
"এখন তো ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে
ছিলে আর অন্য সময় আমাকে দেখলে
ওমন ভাব করে পালিয়ে যাও কেনো
তখন দেখতে পারো না?"
.
.
.
আমি নাফিসার কথার কর্ণপাত না
করে চলে আসি বাসায়।আসার পর
দরজা লাগিয়ে আমার একমাত্র
বিশ্বস্ত সঙ্গী আমার প্রিয় ডায়েরী
নিয়ে বসি আর আজকের ঘটা যাবতীয়
ঘটনা লিখে রাখি।লিখতে লিখতে
ঘুমিয়ে পড়ি।হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়
আমার বড় ভাবীর ডাকে।
.
আমি ফারাহ।ময়মনসিংহ কৃষি
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং
১ম বর্ষ।আর নাফিসা ময়মনসিংহ
মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস প্রথম
বর্ষের ছাত্রী।আমি নাফিসাকে
চিনি ক্লাস টেন থেকে।তখন থেকেই
তাকে মারাত্মক রকম ভালবাসি। আর
ইন্টারমিডিয়েটে আমাদের
ভালবাসা পূর্ণতা পায় আল্লাহর
রহমতে।আমি দেখতে মোটেও ভালো
নাহ।মাঝারি গড়নের হালকা পাতলা
শ্যাম বর্ণের একটি সাধারণ ছেলে।
যার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই কিন্তু
আছে বুকভরা স্বপ্ন আর
আত্মসম্মানবোধ।আ
র অপরদিকে নাফিসা ময়মনসিংহ এর
সেরা দশ জন সুন্দরীর একজন।তার উপর
মেডিকেলের স্টুডেন্ট মোটামোটি
অনেক ছেলেই তার পেছনে পড়ে
থাকে।এই জন্য নাফিসার অনেক
অহংকার যদিও আমার সামনে তা
প্রকাশ করত না।আমি ওরে প্রনাতা
বলতাম।আমার দেওয়া নাম।তার
নাকি এটা খুব ভালো লেগেছিলো।
এভাবে একটু একটু হাসি,একট একটু
ভাললাগা,পাশাপাশি পথ চলার
মাঝখানে হাতে হাত রেখে রেল
লাইনের উপর দিয়ে হাঁটা।মোটকথা
আমাদের সম্পর্ক অনেক ভালো
চলছিল।এই ভালো হয়ত সবার ভালো
লাগে নি।আমাকে যদিও উপর দিয়ে
কেউ কিছু বলত না কারন আমার
ভাইয়ারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু আমার সম্পর্কে নাফিসার
কাছে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা
বলে ইমন নামের একটি ছেলে যে
নাফিসার ভালো বন্ধু।একটি মিথ্যা
হাজারবার কানের কাছে বললে সত্য
মনে হবেই আর হলোও তাই।আমি
মাঝে মাঝে নাফিসার সাথে ঘুমের
বরি খাইতাম।এটা নাফিসার কাছে
ইমন বানিয়ে বলেছে আমি নাকি
নেশাখোর।
আমি আমার এক কাজিন একিসাথে
যাচ্ছিলাম একদিন এটা ইমন দেখে
ছবি তুলে নাফিসাকে দেখায় আমি
নাকি প্লেবয়। এইসব আরোও অনেক
কথা নাফিসাকে বলে আমাকে
নাফিসার মনে বিষিয়ে তুলে।আর
এসবের জন্য নাফিসা আমাকে ফোন
দিয়ে খারাপ ব্যবহার করে।আমি খুব
কষ্ট পাই।আমাকে একটুও বুঝলো নাহ।
আমি ও তাই ওরে ফোন দেই নাই।
নিজেকে নাফিসার ত্রিসীমা
থেকে সড়িয়ে আনি।কিন্তু আজ হঠাৎ
নাফিসা আমার সামনে আসলো কথা
বলতে চাইলো কেন বুঝলাম নাহ।উফফ!
কি যে ভাবছি আমি, পাগল হয়ে
যাচ্ছি ভাবতে ভাবতে।
.
.
.
হালকা ছাই রঙের পাঞ্জাবি টা
পড়ে নদীর পাড়ে পার্কে গেলাম
অনেকদিন পর।আগে আসা হতো
নাফিসাকে নিয়ে এখন তো নাফিসা
আর আমার নেই তাই একা একা
আসলাম আজ।আমি ওরে প্রনাতা
ডাকতাম বেশি ।এসে নদীর ধারে
বাধ রক্ষার্থে যেসব পাটাতন থাকে
ওগুলার একটাতে বসলাম।জায়গাটা
নিরিবিলি।সহজে কেউ আসে না।আর
নিরিবিলি জায়গা আমার সবচেয়ে
পছন্দনীয়। ওখানে বসে একটি
সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে
ছাড়তে আজকের হঠাৎ নাফিসার এমন
নিজে থেকে এসে কথা বলা নিয়ে
ভাবতে লাগলাম কিন্তু কোনো
সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না।এমন
সময় হঠাৎ ফোন আসলো। স্ক্রিনের
দিকে তাকিয়ে দেখি আমার
দ্বিতীয় কাছের বন্ধু রাইয়ান এর নাম।
রিসিভ করলাম, ও জানতে চাইলো
আমি কোথায় আছি।আমিও বললাম
যে জয়নুল আবেদীন পার্কের নিচের
দিকে যে পাটাতন থাকে তার একটা
পাটাতন এর উপর বসে আছি।তারপর সে
বললো যে সে আসছে।আমারো
ভালো লাগলো।আমার মনের অব্যক্ত
কথা গুলার একমাত্র শ্রোতা হল
রাইয়ান।আমার প্রায় সব কথাই ওরে
বলি যদিও ওর সব কথা আমাকে বলে
নাহ। এটা আমি বুঝতে পারি খুব
ভালো করে।
.
.
হঠাৎ খেয়াল করলাম বেলা প্রায়
পড়ে যাচ্ছে মানে সন্ধ্যা হয়ে
আসছে।আর আমি ডুবন্ত বেলা দেখছি।
যাকে গোধুলি বলে।কবি,সাহিত্য
িকরা অনেক বর্ণনা দিয়েছেন
গোধুলি বেলার।কিন্তু আমি যেহেতু
কবি বা সাহিত্যিক নই তাই এর
মনকাড়া সৌন্দর্য উপভোগ করতে
থাকলাম এমন সময় কেউ বলে উঠলো
পিছন থেকে,
.
.
"বাহ!দেবদাস ভঙ্গিতে বসে আছো
দেখা যায়।"
.
.
এই কথা শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি
নাফিসা।একি!নাফিসা এখানে
আসলো কিভাবে?জানলো কেমন করে
যে আমি এখানে বসে আছি?ভাবতে
ভাবতে দেখি রাইয়ান দাঁত বের করে
হাসতে হাসতে আমাদের দিকে
এগিয়ে আসছে।আমার আর বোঝার
বাকি রইলো না যে নাফিসা এখানে
কেমন করে আসলো।আমার খুব রাগ
উঠলো রাইয়ানের উপর ও নাফিসাকে
এখানে নিয়ে আসছে কেনো?
আমাকে কেনো নাফিসার দেওয়া
কষ্টগুলোকে বারবার মনে করিয়ে
দিচ্ছে।তাই আমি কাউকে কিছু না
বলে চলে যেতে লাগলাম ওমনি
নাফিসা আমার হাত খপ করে ধরে
ফেললো আর চোখ রাঙিয়ে আমার
দিকে গভীর একটি রাগান্বিত স্নিগ্ধ
দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
.
"এতো ভাব ধরো কেনো?এত অভিমান
কই রেখে ঘুমাও হু?
.
আমি নাফিসার কথার উত্তর না
দিয়ে বললাম,
.
" হাতটা ছাড়ো।"
.
আমার এই কথা শুনে নাফিসা
চেঁচিয়ে বললো,
.
.
"কেনো কেনো?হাত ছাড়বো কেনো?
ছাড়বো নাহ হুহ।আমার হাত যখন
ধরতে,তখন আমি ছাড়তে বললে কি
ছাড়তে?আমি তোমার হাত ধরেছি
আর জীবনেও ছাড়বো না এই বলে
রাখলাম।"
.
.
নাফিসার এই কথা শুনে আমি কিছু
বলার আগেই রাইয়ান বলে উঠলো,
.
"এইবার নিজেদের অভিমানগুলো
দুজনে মিলে ভাঙাও। নিজেরা কষ্ট
পায়।আর তাদের কষ্টে আমারাও কষ্ট
পাই।আরেকবার যদি এমন হয়,তবে
দুইটারেই মেরে ভর্তা বানিয়ে রুমে
তালা লাগিয়ে রাখবো যত পারো
ঝগড়া করবা।"
.
.
রাইয়ানের কথা শুনে নাফিসা
খিলখিল করে আমার দিকে তাকিয়ে
মিষ্টভাবে হেসে উঠলো আর
নাফিসার হাসি দেখে আমিও হাসি
থামিয়ে রাখতে পারলাম নাহ।
আমিও হেসে দিলাম।
অভিমান ভাঙাতে হয়নি আমাদের।
ওর কথা শুনে অভিমানের দানা গুলো
জমাটবদ্ধ শক্ত বরফ থেকে গলে তরলে
পরিণত হয়ে গেলো এক পলকেই।
তাই পরম মমতায় নাফিসার ফর্সা
ললাটে একটু খানি কোমল চুমুর পরশ
অঙ্কন করে বুকের মাঝে মিশিয়ে
নিলাম যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা
আমাদের আলাদা করতে না পারে।
আর যুগে যুগে ভালো থাকুক ওইসব
বন্ধুরা,যারা এক বন্ধুর কষ্টে কষ্ট পায়।
তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে বন্ধুর
মুখে হাসি ফোঁটায়।এসব বন্ধু আছে
বলেই ভুল বোঝাবোঝিতে কোনো
সম্পর্ক ভাঙে নাহ।এসব বন্ধু আছে
বলেই না জীবনে দুঃখের সাগর পাড়ি
দেয়া যায় আনন্দের আর সমাপ্ত হয়
হাজারো অভিমানের।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন