যেখানে মেঘ এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায়

১. সকাল ১০ টা বেজে পাঁচ মিনিট,বালিসের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আখি ফোন দিয়েছে।ঘুম ঘুম চোখে রিসিভ করলাম কিন্তু হ্যালো বলার সুযোগটা আর পেলাম নাহ্... 
-কই হারামি ফোন ধরতে এতো সময় লাগে কেন??
-আ!আ!আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম! 
-ঘুমাচ্ছিলি মানে?এখন কয়টা বাজে? এতো বেলা -হইছে এখতো বিছানায় কেন হ্যা???ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে সোজা আমার ক্যাম্পাস চলে আসবি..অনেক লেট করে ফেলছিস।
(একদমে বিরতিহীন ভাবে বলেই চললো।আমার কাপালে আজ খারাপ কিছুই আছে)
-হু আসতেছি!
-কিসের হু! উঠ এক্ষুনি! 
ফোন রেখে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।ভাগ্যিস ব্যাগটা মনে করে রাতে গুছিয়ে রেখেছিলাম।
দিনাজপুরের বাসে উঠে পড়লাম বগুড়া থেকে দিনাজপুর খুব বেশি দূরে না মাত্র আড়াই ঘন্টার রাস্তা।ওহ হ্যা বলাই তো হলোনা এই আখি টা কে, আর আমি কেনই বা দিনাজপুর যাচ্ছি।ইসস্ রে আমার সম্পর্কেও তো কিছু বলিনাই! 
আমি মারুফ আমার বাসা বগুড়াতে তবে পড়াশোনার সুবাদে থাকতে হয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
এবার আসি আঁখির প্রসঙ্গে..আখি আমার খুবই ভালো বান্ধবী,যদিও আমাদের বন্ধুত্বের শুরু অনলাইনেই কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বটা এখন আর অনলাইনের মতো আবছা নেই।ওর বাসা নীলফামারিতে তবে পড়াশোনা হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,দিনাজপুর।ও অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এখন দিনাজপুরেই আছে..তাই আমি যাচ্ছি দিনাজপুরে।তবে আসল উপলক্ষ কিন্তু দিনাজপুর নয়।
দুপুর ১ টার মধ্যেই পৌছে গেছি আঁখির ক্যাম্পাসে,মনোরম ক্যাম্পাস।বেশ গোছানো চারিপাশ আমার ভালোই লাগে ওর ক্যাম্পাসটা।সোজা বঙ্গবন্ধু হলে গিয়ে বন্ধু রাকিবের রুমে ব্যাগটা রেখে সোজা দৌড়।রাকিব জানে আমি আজ আসবো কিন্তু এভাবে ব্যাগ রেগে ভোঁ দৌড় দিবো সেটা তো কল্পনা করেনি তাই রীতিমতো ভড়কে গেছে হয়তো।আমার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা ওকে ভড়কে দেয়ার কিন্তু আঁখি ওইদিকে বসে আছে, ওরে বলেছি এসে পড়ছি কিন্তু আমি তো জানতাম লেইট হয়ে যাবে।দেড়টা বেজে গেছে।
ওইযে তো বসে আছে ওর ফ্যাকাল্টির সামনে।অনেকদিন পর ওর সাথে দেখা।তবে ভয় লাগতেছে যদি ঝাড়ি দেয়,আলসেমি টা না করলে অনেক আগেই আমার এখানে পৌছে যাওয়ার কথা ছিলো।যাইহোক, এগিয়েই গিয়েই বলে ফেললাম-''সরি দোস্ত দেরি হলে গেলো"।তাকিয়ে থেকে হেসে বললো ঠিক আছে হইছে আর সরি বলতে হবেনা তোর। আখি এতোটাও রাগি না আমি জানি তারপরেও কেন জানি আমার খুব ভয় করে।যাকে মানুষ খুব সম্মান করে তাকে নাকি ভয় লাগে আমারো সেই রকম অবস্থা আরকি।ও আমার শুধু বান্ধবীই না, ওরে আমি প্রচন্ড শ্রদ্ধা করি তবে দুষ্টামি যে করিনা তাও একেবারে বলা যাবেনা...।
দুজনে একসাথে দুুপুরের খাবার শেষ করে আমাদের প্লান নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। ওহ আমাদের প্লান টাও তো জানাতে ভুলে গেছি।ভুলো মন তো কিচ্ছুই মনে থাকেনা আরকি। আমি আর আখি প্লান করেছি মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাবো।প্লানটা অবশ্যে একদিনের না অনেক আগে থেকেই চাচ্ছিলাম দুজনেই কোথাও একটা ট্যুর দিবো কিন্তু সময় পরিস্থিতি কোনটাই অনুকূলে ছিলোনা।তাই প্লান করা পর্যন্তই,যাওয়া আর হইতোনা। হঠাৎ ওরে বললাম চল মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাই ও অবশ্যে প্রথমে রাজি হচ্ছিলনা। কারন মেঘের রাজ্যে তো চাইলেই হারিয়ে যাওয়া যায়না তাইনা? যাইহোক অবশেষে আমরা সময় পরিস্থিতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম, আর যেই কথা সেই কাজ।তুললো ঝোলা, চললো ভোলা স্টাইলে ব্যাগা গুছিয়ে হাজির হলাম।উদ্দেশ্য সাজেক ভ্যালী যাবো বলতে গেলেই ওটাই আমাদের মেঘের রাজ্যে!
১৮০০শ ফুট উচু একটা পাহাড়ে দাড়িয়ে আছি দুজন,চারপাশ দিয়ে মেঘ বয়ে চলছে।মেঘের আড়ালে খানিক দূরের বস্তুও দেখতে পারছিনা।মাঝে মাঝে খুব কাছে এসে মেঘ গুলো ছুয়ে দিয়ে শিহরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে...ভাবলেই যেন আনন্দে শিহরিত হয়ে মন...।

২.আখি বাস ভ্রমন করতে পারেনা ওর নাকি বমি পায় তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনে করে যাবো।ট্রেন ভ্রমণ অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস, তেমন বোরিংনেস কাজ করেনা।খোলা মাঠ সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে ট্রেন ঝিক ঝিক করে আপন গতিতে ছুটে চলে। প্রকৃতি সবুজ গ্রামীন পরিবেশ যেন অনেক কাছে এসে যায় ক্ষণিকের জন্যে।তাই আর দেরি না করে দিনাজপুর টু ঢাকা সোনারবাংলা এক্সপ্রেসে দুইটা অনলাইন টিকেট কেটে ফেললাম। সকাল ৭.৪৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন ছাড়বে ঢাকা কমলাপুরের উদ্দেশ্যে।আখিকে দ্রুতই ওর মেসে পৌছে দিয়ে আমি হলে ফিরে আসলাম।বেশ ক্লান্ত লাগতেছে, কিন্তু এতদিন পর বন্ধু রাকিবের সাথে দেখা যদি আড্ডা না হয় ব্যাপার মেনে নেয়া কষ্টকর।ছেলেদের হল রুম বড়ই অগোছালো রাকিবের রুমটাও ব্যতিক্রম না। হলের ক্যান্টিনের  মোটা চাউলের ভাত আর একটুকরো বয়েলার মুরগির মাংস সাথে পানি মিশ্রিত ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে ফিরে এলাম হলে।রাকিব অবশ্যে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে চাইছিলো কিন্তু অযথা ওরে আর প্যারা দিতে ইচ্ছে হলো না।আর আমি তো নিজেও হল বাসী তাই হলের খাবার হজম হতেও আমার বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই।রাকিবের রুমমেট আশরাফ ছেলেটা ভালোই গান বাজনা করে রাকিব বলেছিলো একদিন, আমারো ইচ্ছে ছিলো ছেলেটার গান শোনা.।বললাম,আশরাফ একটা গান শুনাও।বস্তুত গায়ক রে গান বলতে বলাটা সহজ হলেও গায়কের পক্ষে হুট করে গান বলাটা মোটেও সহজ না। কারন তারা দ্বিধাদ্বন্দে পরে যায় কোন গানটা গেয়ে শোনাবে, আর কোনটা ভালো লাগবে এই সময়টায় গাইলে।আশরাফের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলনা,সে ভাবতে লাগলো।আমি তার অবস্থা বুঝে বললাম তোদের গায়ে যে ময়লা টি-শার্ট আর অগোছালো রুম এটা নিয়েই একটা গান বলে ফেল! এতো ভাবতে হবেনা।আশরাফ মৃদু হেসে গিটার হাতে নিয়ে গাইতে শুরু করলো-
"ময়লা টি-শার্ট,
ছেঁড়া জুতো
কদিন আগেই
ছিল মনেরই মতো
দিন বদলের
টানা-পোঁড়েনে
সখের ঘুড়ি নাটাই সুঁতো
ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো
তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?"
গান শুনতে শুনতে ক্লান্ত আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানিনা।ঠিক ৬ টার দিকে মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠলো।দ্রুত উঠে ফ্রেস হলাম।আঁখির ফোন-"কিরে উঠেছিস,ফ্রেস হয়ে দ্রুত চলে আয় আমার মেসের সামনে!আর হ্যা রিকশা নিয়ে আসিস, এখানে রিকশা নেই কিন্তু!''দেরি না করে ফ্রেশ হয়ে রাকিবের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাইতে যাইতে দুইটা জিনিস ভাবতেছি।প্রথমত,আমি আমার মোবাইলে আলার্ম দেইনি,ঘুমানোর আগে আলার্ম দিয়ে ঘুমাইতে চাইছিলাম কিন্তু সেটা তো সম্ভব হয়নি কিন্তু এলার্ম ঠিকই বেজেছে, আর দ্বিতীয়ত, আখি এতো দ্রুত ঘুম থেকে উঠলো কেম্নে? ও তো এতো দ্রুত উঠতে পারেনা।যাইহোক আঁখিরে পিক করে সোজা স্টেশনে পৌছালাম।সকালের নাস্তা সেরে একদম ট্রেনে উঠবো আরকি।আঁখি কে বললাম ফোনের এলার্মের কথা, ও হেঁসে বললো আরে বোকা আমি জানতাম তুই এলার্ম দিতে ভুলে যেতে পারিস! তোর তো আবার ভুলো মন,তাই ক্যাম্পাসে যখন তোর সাথে সেল্ফি তুলতেছিলাম তখন এলার্ম টা অন করে দিয়েছিলাম। আমি তো শুনে অবাক এমন একটা বন্ধু থাকলে ভুলো মন হলেও বিপদে পড়তে হবেনা....
ট্রেনের বিকট হর্ণ বেজে উঠলো জানান দিলো সে এখন ছুটতে প্রস্তুত। জ নং বগির ৪১ এবং ৪২ নাম্বার সিট আমাদের.সেকেন্ড ক্লাস চেয়ার কোচ।খারাপ না,মোটামুটি ভালোই একটু পরেই ট্রেনের দরজা তাই উঠে গিয়ে দরজায় দাড়াতে বেশি বেগ পেতে হবেনা। আমাদের সামনে সিটে বসে আছেন এক আপু,বয়সে আমাদের থেকে খুব একটা বড় হবে না, দেখতে সুন্দর মায়াবী হাস্যেজ্জ্বল চেহারা একটু পরেই পানির বোতল হাতে নিয়ে একটা ভাইয়্যা আসলেন, উনার পাশেই বসলেন।বুঝালাম হয়ত তারা স্বামী স্ত্রী। আঁখির জীবনে প্রথম ট্রেন ভ্রমণ এটি তাই ও অনেক এক্সাইটেড।চোখে মুখে আনন্দের ছাপ।আমারো খুব ভালো লাগতেছে অবশেষে আমরা একসাথে ভ্রমণে যেত পারতেছি।কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো সব।
আখি বললো আমরা কি সত্যিই যাচ্ছি??আমার কেমন জানি বিশ্বাস হচ্ছেনা!মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখতেছি।আমি বললাম আচ্ছা তাইলে তোর হাতে চিমটি কেটে দেখি স্বপ্ন, নাকি সত্যিই!না না!চিমটি না! তোর কার্ভ চুলে একটু টান দিয়ে পরখ করি ঠিক আছে?বিনা নোটিশে আমার হাতেই আখি চিমটি দিয়ে বসলো, আর বললো আমার চুলের দিকে হাত দিলে তোর খবর আছে দুষ্টু কোথাকার।ওই চিমটি দেয়ার পর, আর আমি চিমটি খাওয়ার পর বুঝলাম আমরা বাস্তবেই আছি স্বপ্নে নয়! শেষ হর্ণ দিয়ে ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে শুরু করলো আর মনে হতে লাগলো সব কিছু যেন পিছনের দিকে যাচ্ছে.........

৩.ঝিক্ ঝিক্ শব্দ করে ট্রেন চলতেছে তার আপন গতিতে! একটার পর স্টেশন পিছনে ফেলে ছুটছি আমাদের গন্তব্যের পানে। 
ট্রেনের মধ্যে এক বিচিত্র চিত্রের সমাহার।হকার ফেরিওয়ালার- "পেয়ারা! মিষ্টি পেয়েরা!" ডাকে যেন প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়া মন ফিরে আসলো ট্রেনে মধ্যে। আঁখি পেয়ারা মাখা খাবে তাই ডাক দিলাম পেয়ারা ওয়ালাকে, শুধু তার কাছে পেয়ারাই নেই সাথে কাচা আমড়াও রয়েছে। কড়া ঝাল দিয়ে মাখিয়ে নিলাম। আমার আবার টক ঝাল বেশি পছন্দ না তবে আখি দিব্যি খেতে লাগলো ওর খাওয়া দেখে লোভ হচ্ছিলো অবশ্যে, কিন্তু ও তো দেয়ার বান্দা না।আমার সকল প্রেডিকশন রে পিছনে ফেলে বললো, ওই! তুই খাবি পেয়ারা মাখা? জানি তুই ঝাল পছন্দ করিসনা তাও একটু খেয়েই দেখ ভালো লাগবে।আমি আর না করতে পারলাম না।বাহ্! সত্যিই তো!মিষ্টি পেয়ারা। ১১.৪৫ মিনিট, ট্রেনের স্পিকারে জানান দিলো আমার একটু পরেই বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর উপর দিয়ে যাবো।বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন ভ্রমণ অনেক রোমাঞ্চকর।
 মনে হয় এই বুঝি ট্রেন যমুনা নদীর মাঝে পড়ে যাবে।তবে অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।আঁখিরে নিয়ে ট্রেনের গেটের কাছে আসলাম।ট্রেনের গেটে দুজন বসে পুরো সৌন্দর্য টা উপভোগ করবো। ট্রেনের গেটের কাছি যেতেই আখি ভয়ে পেয়ে গেলো।ভয় পাবার ই কথা কারন পায়ের নিচেই তো যমুনা নদী।অনেক কষ্টেও রাজি করাতে পারলাম না।তাই বাধ্য হইয়ে গেটেই দাড়িয়ে দেখতে লাগলাম।সামনে তাকালে শুধু পানি আর পানি, দূরে  সাদা সাদা চর জেগে উঠেছে যমুনা মাঝে।নদীর শীতল বাতাস গায়ে লাগছে! এ যেন এক অন্যে রকম অনুভূতি।আঁখিও আমার পাশে দাড়িয়ে আছে, বাতাসে ওর চুল গুলো উড়ছে, মাঝে মাঝে হাত দিয়ে চুলে সরিয়ে নিচ্ছে আর আনমনে কি যেন একটা ভাবতেছে....হয়ত নদীর বিশালতার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ক্ষণিকে জন্যে!
-মারুফ দেখ নৌকা!পাল তোলা নৌকা!
-হ্যা! তাইতো ওইযে দূরে একটি পাল তোলা নৌকা যাচ্ছে।
আঁখির নৌকা খুব পছন্দ, ইচ্ছে আছে একদিন ওরে নিয়ে পদ্মা নদীতে নৌকা ভ্রমণ করবো। একদিন না হয় হলাম পদ্মা নদীর মাঝি।তবে একটা শর্ত আছে আঁখিকে নীল শাড়ি পড়তে হবে...
সিগারেটের বাজের গন্ধের কাছে হার মেনে স্থান ত্যাগ করে সিটে এসে বসলাম দুজনে।সাড়ে চার মাইলেই যমুনা সেতু যেন চোখের নিমিষেই অতিক্রম করে ফেললাম।উত্তরবঙ্গের গ্রামীন সবুজ নির্জনতা থেকে বের হয়ে ঢুকে গেলাম যান্ত্রিক শহরের মাঝে।যন্ত্র দানব শিশ বাজিয়ে সমান তালে শহরের মাঝ দিয়ে ছুটতে লাগলো তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। 
দুপর ১.২০, ট্রেনের স্পিকারে জানান দিলো আমরা আর একটু পরেই কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌছে যাবো।১.৩০ আমরা কমলাপুর রেলস্টেশনে নামলাম, আগেই বলেছি আখি বাস ভ্রমণ করতে পারেনা তাই আমাদের ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ট্রেনেই যেতে হবে।সোজা ছুটলাম টিকেট কাউন্টারের দিকে।কপাল ভালো তাই ফাস্টক্লাস বগিতে দুইটা টিকেট ম্যানেজ করতে পারলাম।ট্রেন ছাড়বে রাত সাড়ে দশটায়। স্টেশনে পাশের রেস্টুরেন্টায় দুজনে হরেক রকম ভর্তা দিয়ে দুপরের খাবার টা খেয়ে নিলাম!আশানুরূপ ভালো ছিলো খাবার টা।যেহেতু সাড়ে দশটায় ট্রেন ছাড়বে তাই এতোটা সময় স্টেশনে বসে না থেকে ঢাকা শহর ঘোরার ইচ্ছা জাগলো আঁখি মনে।প্লান করলাম প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি ওখান থেকে নীলক্ষেত।বই প্রেমিকদের জন্যে বইয়ের স্বর্গ হলো নীলক্ষেত!তাই নীলক্ষেত না গেলেই নয়।সিএনজি ভাড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয় দিকে রওনা শুধু করলাম।অসংখ্য গাড়িঘোড়ার হর্ণের ঝাঁজালো শব্দ, ডাস্টবিনের ময়লা দুর্গন্ধ আর ট্রাফিক জ্যামে  সিএনজির খাচার মধ্যে আটকে থেকে যেন মনে হতে লাগলো আমরা বন্দী কারাগারে আটকে আছি...
8.সিএনজিতে উঠেই মনে হচ্ছে কখন নেমে যাবো।অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসতেছে আমার।মারুফকে বললাম টিএসসিতে গিয়ে সিএনজি ছেড়ে দিতে।ঢাকা শহরের শ্বাসরুদ্ধকর যান্ত্রিকপরিবেশ আর অস্বস্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললাম কিছুক্ষণ পরেই মারুফের ডাক!এই আঁখি ঘুমাচ্ছিস নাকি?ওঠ আমরা টিএসসিতে পৌছে গেছি।সিএনজি থেকে নেমে মনে হলো যেন হাফ ছেড়ে বাচলাম আমি।প্রানে স্বস্তির নিঃশ্বাস এলো।কিন্তু প্রচন্ড গরম আর টানা জার্নিতে আমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো অসহ্যে লাগছে সবকিছু।কি জানি! ছেলেটা কই যে নিয়া যাচ্ছে আমায় সেটাও বুঝতে পারছিনা।ওইযে টিএসসি চত্তর।আমারে  ব্রেঞ্চে বসাই রেখে,থাক আসতেছি বলে শয়তান টা কই যে গেলো!!মনে হচ্ছে আচ্ছা করে মাইর লাগাই।ওইযে আসতেছে!হাতে দুইটা ডাব নিয়ে বান্দা হাজির।নিজের রাগ আর কন্ট্রোল করতে পারলাম না,বলেই ফেললাম দাত কেলাবিনা একদম!একটা ডাব আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো হইছে আর রাগ করতে হবেনা!ডাব টা খেয়ে নে দেখ ফ্রেশ লাগবে অনেক।
প্যারাসিটামল আর ডাবের পানি খেয়ে মনে হলো শরীরে এনার্জি ফিরে পেলাম আমি।আশে পাশে কত ছাত্রছাত্রী।গোল হয়ে মাঠের কোণে গাছের ছায়ায় বসে আছে।কেউবা গ্রুপ স্টাডি করছে আর কেউবা মাতিয়ে আছে বন্ধুদের সাথে আড্ডায়।কেউ কেউ ব্যাগ নিয়ে ক্লাসের দিকে ছুটছে।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জীবিকার তাগিদে ফুল বিক্রি করছে,আবার কেউ কেউ আবার ছোট ছোট টুকরিতে করে পান সিগারেট ফেরি করে বেড়াচ্ছে।এতো ছোট ছোট বাচ্চাদের কাধে জীবন সংসারে বোঝা খুব দ্রুতই এসে গেছে,ভেবে মায়া লেগে যায়।আমি আর মারুফ দুজনে ব্যাগ কাধে নিয়ে হাটতেছি ঢাবির প্রাঙ্গণে।ঘড়ির কাটায় দেখি প্রায় তিনটা বেজে গেছে মারুফ রিকশা ডাকদিলো এখান থেকে নীল ক্ষেত বেশি দূরে না এইতো সামনেই।২০ মিনিটেই পৌছে গেলাম নীলক্ষেতে।রিকশা থেকে নামলাম। সারি সারি বইয়ে দোকান,যেন বই এর রাজ্যে।ভারি ব্যাগ নিয়ে এই রোদের মধ্যে হাটতে ভালোই বেগ পেতে হচ্ছে  আমাকে।হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখি মারুফ নাই!ভয়ে মুখটা শুকিয়ে উঠলো। অপরিচিত সবকিছু অসহায় মনে হলো নিজেকে।ফোন বের করে কল দিলাম কিন্তু রিসিভ হইলো না! ভয়ে কান্না পেয়ে গেলো আমার।কখন চোখে পানি চলে আসেছে সেটাও বুঝতে পারিনি, পিছন থেকে কে যেন আখি বলে ডাক দিলো।পরিচিত স্বর! দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম।হাতে পাশের দোকানে বই রাখা ছিলো ওটা দিয়ে ঢিপ করে বাড়ি বসালাম শয়তান টার মাথায়।মারুফ আমতা আমতা করে বললো রোদে তোর হাটতে সমস্যা হচ্ছিলো তাই তোর জন্যে হ্যাট কিনতে গেছিলাম পাশে দোকানে।আমি আর কিছুই বললাম না শুধু কান্না পাচ্ছিলো আমার।হাতে যে বইটা তুলে নিছিলাম 'A BRIEF HISTORY OF TIME' আর এর কয়েকটা খন্ডও কিনে ফেললাম।আর ভালো লাগছিল না তাই বললাম চল হাতিরঝিলে যাবো এখনো ভালোই সময় আছে।আবারো সিএসজি যাত্রা করে হাতিরঝিলে পৌছালাম।যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।দেখার মতো উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই নেই তবে সোডিয়াম ল্যামপোষ্ট আর লাল নীল বাতিতে সাজিয়ে রাখা ব্রিজটা দেখতে ভালোই লাগতেছিলো।আমরা ব্রিজের উপর হাটলাম কিচ্ছুক্ষণ।লেকের পানিতে ব্রিজের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে।অনেক সুন্দর লাগছে।লেকের খুব কাছে যেতে ইচ্ছে হলো কিন্তু মারুফের বাচ্চা মোটেও নামতে রাজি হচ্ছেনা।কঠিন স্বরে বললো ট্রেন মিস হবে।তাই আমিও আর জেদ করলাম না।১০ টার মধ্যে আমরা স্টেশনে পৌছে গেলাম।রাতে খাবার খেয়ে ট্রেন উঠে পড়লাম।মারুফ মৃদু স্বরে বললো সরি রে!প্রশ্নোত্তর চোখে চেয়ে রইলাম তার দিকে-
-আঁখি! 
-হু বল।
-নীলক্ষেতে তখন ভয় পাইছিলি তাইনা?
-মোটেও না!আই এম স্ট্রং এন্ড ব্রেক গার্ল।

জ্বানালার পাশে আমার সিট, তবে এসি কামরা তাই জানালা খোলার ব্যাবস্থা নেই।ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর দেখলাম মারুফ ঘুমিয়ে পড়েছে।আমার ব্যাগ থেকে স্টিফেন হকিংস এর বইটা বের করে করে কোভার পেজের উল্টা পাশে লেখলাম "-তোর জন্যে"।বইটা ওর ব্যাগে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।আর ট্রেন ছুটে চললো মেঘের রাজ্যে.....

৫.সকাল ছয়টায় চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌছে যাই আমরা। সকালে নতুন ঝলমলে সূয উঁকি দিচ্ছে। এই স্টেশন আমার খুবই পরিচিত জায়গা নিয়মিতই পদচারণ পড়ে আমার।প্লাটফর্ম নাম্বার দুইয়ে আমাদের প্রিয় শাটল ট্রেন, সাতটায় ছেড়ে দিবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে কিন্তু আমাদের গন্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয় নয়। স্টেশন থেকে বের হয়ে খাগড়াখড়ির টিকেট কাটলাম।খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি হয়ে সোজা সাজেক ভ্যালি।ডিম ভাজি আর গরম পরেটা দিতে সকালের নাস্তা সেরে বাসে উঠে পড়লাম।খাগড়াছড়ি যাবার রাস্তা ঠিক স্বপ্নের মতো উচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা।দিগন্ত জুড়ে সবুজ পাহাড় আর পাহাড়।বন্দর নগরী ব্যস্ত শহর চট্টগ্রাম ছেড়ে বাস চলতে লাগলো নিরিবিলি পাহাড়ি রাস্তা ধরে।আঁখি জানালা দিয়ে আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তা দেখছে।জিগ্যেস করলাম তোর কি বমি বমি পাচ্ছে? টেবলেট খাবি? আঁখি দৃষ্টি যেন আটকে গেছে ওই দূর পাহাড়ের চূড়ায়।
-মারুফ!দেখ কত্ত সুন্দর পাহাড়! সকালের সোনালী রোদে ঝলমল গাছের সবুজ পাতাগুলো।
-হ্যা,আমাদের দেশ অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারী। এই পাহাড়ের চুড়ায় তাকা...
-ওয়াও!ওইটা কি রে? স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করছে পাহাড় চুড়ায়? 
-ওটা হলো বৌদ্ধ প্যাগোডা!প্যাগোডা গুলা পাহাড়ের চূড়ায় বানানো হয়।আর সোনালি রংএর আবারণ দেয়া হয় যেন দূর থেকে স্বর্ণের মতোই মূল্যবান মনে হয়।
একদল পাহাড়ি উপজাতি ছেলে মেয়ে হৈচৈ করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে।আমাদের বাস ধীরে ধীরে চলছে সামনে আর্মি চেকপোস্ট তারপর পরই খাগড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ড।সাড়ে আটটায় খাগড়াছড়ি পৌছালাম।এবারের গন্তব্য সাজেক আমাদের স্বপ্নের মেঘের রাজ্যে।সাজেক যেতে হয় চান্দের গাড়িতে করে।জিপের মতো একধরের গাড়ি, অনেক শক্তিশালী পাহাড়ী যানবাহন আরকি।সাজেকে বাঙলীদের বসবাস নেই, সবাই উপজাতি।
খাগড়াছড়ি থেকে আমরা নয়টায় চাদের গাড়িতে করে সাজেকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম আবার।
খাগড়াছড়ি ছাড়িয়েই গাড়ি প্রবেশ করলো রাঙামাটি জেলায়।রাঙামাটি জেলা আরো সুন্দর..রাঙামাটি জেলায় প্রবেশ করার পর শুরু হলো পাহারের অপূর্ব সৌন্দর্য। আঁখি তন্ময় দৃষ্টিতে পাহাড় দেখছে আর আমি ওর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখতেছি..।আমার কানে হেডফোন লাগনো,গান বাজতেছে-
"মেঘের ওই দেশে কি হারাও আনমনে?
বৃষ্টির ওই ছোঁয়াতে কি আমায় খোঁজো এখনও?"
চারিপাশে সারি সারি পাহাড়!দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ আর সবুজ।মাঝে মাঝে ঐ দূরে ছোট ছোট জুম ঘর চোখে পড়ে।উচু নিচু পাহারের মাঝে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা রাস্তাতে আমাদের গাড়ি সামনে এগুতে লাগলো।এই দুর্গম এলাকাতেও পাহাড়ের মাঝে হাড় ভাঙা খাটুনি করে গাড়ি জন্যে রাস্তা করেছে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী।পথ চলতে চলতে দুপাশে চোখে পড়লো পাহাড়িতে বাড়িঘর।দুপাশে ছোট ছোট বাচ্চারা হাসিমুখে দাড়িয়ে ছিলো চকলেটের জন্যে।আঁখি আসার সময় ব্যাগে অনেক চকলেট এনে ছিলো যেন বমি না হয়।সেখান থেকে কয়েকটি চকলেট ছুড়ে দিলো।খুশি মনে কুড়াতে লাগলো মায়াবী চেহারার পাহাড়ি বাচ্চা গুলো।এভাবে চলতে চলতে আমরা পৌছালাম মাসালাং বাজার আর্মি ক্যাম্পে। এখান থেকে পারমিশন পত্র আর নাম এন্ট্রি করে আবার গাড়ি ওঠে পরলাম। দুই ঘন্টা পর আমরা পৌছালাম স্বপ্নের সাজেকে! আমরা যখন সাজেক পৌঁছালাম  তখন ঝুম ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দৌড় দিলাম ছোট ছোট রিসোর্ট গুলোর দিকে।আগে থেকে বুকিং না দেয়ার কারণে আর রিসোর্ট খুজে পাচ্ছিলাম না।একরকম বিপদের মধ্যেই পড়লাম।একা হলে সমস্যা ছিলো না কিন্তু সাথে আখি আছে।হঠাৎ মনে পড়লো কৌশিক টাংচাংগিয়ার কথা।আমার ব্যাচ মেট বন্ধু।ওর মামার নাকি পরিচিত রিসোর্ট আছে সাজেকে।তাই ওরে কল দেয়াতে সেই সব ম্যানেজ করে দিলো।অবশেষে ''নাগরাই নক"নামের রিসোর্টে আমাদের দুজনের ঠাঁই মিললো... 
৬.'নগরাই নক' রিসোর্ট দেখতে দারুন,বেশ গোছালো।দেখতে বাঁশ আর ছনের তৈরি কুঁড়ে ঘরের মতন হলেও ভিতরটা দারুন পরিপাটি।০৫,০৬ নম্বরের ছোট ছোট দুটি রুম পাশাপাশি লাগানো।ব্যাগ পত্র নিয়ে যে যার রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হলাম।ওখানে পানিটা কেমন যেন!সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়ার পরেও মনে হচ্ছিলো হাতে বোধহয় আরো সাবান রয়ে গেছে।পাহাড়ে পানির সংকট,এই পানি গুলো খুব কষ্ট করে আনা হয় তাই অপচয় করার প্রশ্নই উঠেনা। আমি আর আখি দুপরের খাবার শেষ করে  রিসোর্টের বারান্দায় গিয়ে বসলাম।বসেই আমি হতবাক!আমি একা হতবাক না আঁখিও দেখে বিস্মিত হয়েছে!মাই গড!! এতো দেখি সত্তি সত্তি মেঘ!!মেঘ যে সত্যিই এইভাবে জমাট বেঁধে  থাকে তা ছিলো আমাদের কল্পনার অতীত!আঁখি চিল্লাই উঠলো এতো সুন্দর দৃশ্যে দেখে!রিসোর্টের বারান্দা থেকে যতদূর চোখ যায়  দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি পাহাড় আর পাহাড় আর তার মাঝে জমে আছে সাদা সাদা মেঘের ভেলা।এই দৃশ্যেটা আজীবন দেখলোও দেখবার স্বাদ মিটবেনা।
বিকালের রোদটা  একটু ধরে আসলে হেলিপ্যাডে গেলাম সূর্যাস্ত দেখতে। সাজেকে সেনাবাহিনীদের ব্যবহার করার জন্যে দুইটা হেলিপ্যাড রয়েছে দুটো প্যাড থেকেই ওই বিশাল আকাশের অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায়।বিকালে রক্তিম আলো আমাদের চোখ মুখে খেলা করছে।তাকিয়ে দেখলাম আখির দিকে রক্তিম আলো ওর মুখে প্রতিফলিত হয়ে যেন অনাবিল এক সুন্দরের উপমা তৈরি করেছে তার চেহারায়।
নিমিষেই টুকটুকে লাল সূর্যটা যেন পাহাড়ে মাঝে হারিয়ে গেলো,আধার নেমে পড়লো মেঘরাজ্যে।
রাতে সাজেক আরো সুন্দর আরো জমকালো।রাতের আকাশের সহস্র নক্ষত্রকে সাথে নিয়ে হাটতে লাগলাম দুজনে। রংবেরঙের আলো ছেয়ে গেছে ক্ষুদ্র এই শহরটায়।দূর থেকে গিটারের শব্দ কানে ভেসে আসতেছে।ক্যাম্প ফায়ার করে গানের আসরে মেতে তারা।বেশিক্ষণ বাহিরে থাকলামনা, আর আঁখিও অনেক কান্ত।রিসোর্টে ফিরে রাতে খাবার খেয়ে যে যার রুমে ঘুমাতে গেলাম। কাল আলো ফোটার আগেই উঠতে হবে।একটা অদ্ভূত সৌন্দর্য দেখবো সকালে...
ভোর ৪.৩০,পূর্ব আকাশে হালকা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।সমগ্র আকাশ আলোর বর্ণিল ছটায় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে!যেনে কিসের আগমনের প্রতিক্ষায়..ঘুম বুড়ি আঁখি রে ডাকতেই উঠে পড়লো সে।খুব দ্রুতই রেডি হয়ে আমরা বের হলাম হেলিপ্যাডের উদ্দেশ্যে।আকাশের রং তখন ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিকট আকাশের নির্দিষ্ট একটা অংশ অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগলো। আমাদের অপেক্ষার প্রহর বাড়তে লাগলো।আর তারপরেই উদয় হলো সূর্যের।হাজার বছরের পুরানো সেই সূর্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা কিনা প্রতিদিনই এভাবে প্রবল দম্ভে হাজির হচ্ছে সবুজ এই পৃথিবীর দুয়ারে।এতো কাছ থেকে জীবনের এই প্রথমবারের মতো দেখা!
মুঠো ফোনের ক্যামেরায় দৃশ্যে হলো বন্দি করা চেষ্টা চালিয়ে গেলাম সমান তালে।সূর্যদ্বয় দেখার পর আমরা রওনা হলাম সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চূড়ায় 'কংলাক পাহাড়ে'।এই পাহাড় টা কেমন রহস্যময়।আখির অনেকদিনের ইচ্ছে পাহাড়ে চড়া।অবশেষে তার ইচ্ছাটি পূরণ হবে ভেবে আমার অনেক ভালো লাগতেছে।পাহাড়টির উচ্চতা অনেক। সমতল ভূমি থেকে নাকি ১৮০০শ ফুট উপরে।পাহাড়টায় চড়ায় ট্রেইলটা মোটামুটি সহজই কিন্তু ভয় হচ্ছিলো আঁখিরে নিয়ে।পাহাড়ি রাস্তায় চলাচল বা পাহাড়ে চড়ার অভিজ্ঞতা নেই তাই একটু ভুল হলেই পা মচকে যাবে।আঁখিরে আমার সামনে রেখে উঠতে লাগলাম ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌছে গেলাম পাহাড় চূড়ায়। আঁখির সাহসিকতা দেখে আমি সত্যেই মুগ্ধ। এতো উচু পাহাড়ের উপরেও মানুষের বসবাস।এখানে কয়েকশত বছর ধরে 'লুসাই' ও 'ত্রিপুরা' উপজাতির বসবাস।প্রচন্ড তৃষ্ণা লাগলো দেখলাম পাহাড়ি ডাব আর বাশ কোরাল। বাশ কোরাল পাহাড়ি পানীয় ২০ টাকা দিয়ে কিনলাম।আমি খেতে পারলেও আঁখি খেতে পারলোনা গন্ধের কারনে।অবশেষ ডাবের পানি আর দুইটা কলা খেয়ে আমাদের ক্ষুধা ক্ষণিকের জন্যে নিবারণ করলাম।
এখান থেকে আমাদের গন্তব্য এখন 'কমলক ঝর্ণা' এটির আরেক নাম লুসাই ঝর্ণা।পাহাড়ে উঠার পথে লাঠি কিনেছিলাম। পাহাড়ি রাস্তায় চলাচলের জন্যে লাঠি অপরিহার্য, সেটাই সম্বল করে যাত্রা শুরু করলাম।এই ঝর্ণা ১৫০০ ফুট নিচুতে।নামার সময় খাড়াই বেয়ে নামতেই থাকলাম,আমাদের সাথে আরো পর্যটক রা ছিলেন।এক আংকেল তার পুরো পরিবার কে নিয়ে এসেছিলাম পরিচয় হয়ে জানলাম উনার বাড়ি রংপুরে।মানে আমাদের উত্তরবঙ্গের মানুষ।আন্টির এবং আন্টির মেয়ের সাথে আখির ভালো সখ্যতা হলো। সবাই সতর্কতার সাথে নামতে লাগলাম।নামছি তো নামছি। যেন শেষ হবার নয়।যাইহোক ৪০ মিনিট একটানা নীচের দিকে আঁকাবাকা  পথে নামতে নামতে ঘন সবুজের মাঝে ঝর্ণার শব্দ শুনতে পেলাম।সবাই আনন্দের চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
ঝর্ণা যেন আরেক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যে।পাহাড়ের বুক চিড়ে ঠান্ডা হিম শিতল স্বচ্ছ পানি বেয়ে পড়ছে ঝরঝর শব্দ করে।সবাই নেমে পড়লাম ঝর্ণা পানিতে...ক্লান্তি অবসাদ যেন নিমিষেই ঝর্ণার শিতল পানির মাঝে মিলিয়ে গেলো.....

  ৭.জলখেলা তো অনেক হলো এবার রিসোর্টে ফেরার পালা।পাহাড়ি মশা আর খারা পাহাড় বেয়ে অনেক কষ্টে অবশেষে রিসোর্টে ফিরলাম।দুজনের অবস্থা খারাপ।প্রচন্ড ক্লান্ত আর বিদ্ধস্থ, ফ্রেশ হয়েই দুপরের খারাপ খেয়ে শুয়ে পড়লাম।খোলা জানালা দিয়ে মেঘ দেখা যাচ্ছে।সাদা সাদা মেঘ উড়তেছে।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।আঁখির ডাকে ঘুম ভাংলো আমার,দেখি প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে।দুজনে বেড়িয়ে পড়লাম।আঁখির ইচ্ছে হলো ভিন্নধর্মী খাবার খাওয়ার তাই বাজারে দিকে রওনা দিলাম।চারিদিকে যা দেখতেছি তাই দেখেই মুগ্ধ হয়ে হচ্ছি দুজনেই।যেন স্বপ্নপুরীতে আছি আমরা।কবি বিল ব্রাইসন বলেছেন-
"নতুন অচেনা কোনো দেশে গেলে মানুষ শিশু বয়সের বিস্মিত হওয়ার মতো অনুভূতিটি ফিরে পায়।" কথাটি সত্যতা এখন বেশ উপলব্ধি করতে পারতেছি।
বাজারের এককোণে স্টল,অনেকটাই নিরিবিলি। আমরা গিয়ে ব্রেঞ্চে বসলাম।দুটো পাহাড়ি মেয়ে দোকানটা দেখাশুনা করছে।শুনেছি উপজাতিদের মাঝে মেয়েদের প্রাধান্যে বেশি, অর্থাৎ মাতৃতান্ত্রিক আরকি।মেয়েরা রোজগার করে আর ছেলেরা বাড়ির কাজ করে।যাইহোক, বাঁশ চা খেলাম সাথে পাহাড়িদের হাতে বানানো কিছু মিষ্টি আর ঝাল পিঠা।খেতে মন্দ নয়। আঁখিও দেখি বেশ আগ্রহ নিয়েই খেলো।হাটতে হাটতে আমরা প্রায় সাজেকের এমাথা থেকে ওমাথায় চলে এসেছি।সাজেকের সীমানা শেষ।মাঝখানে বিশাল বড় খাদ আর তার ওপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে।অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।চাদের আলো আর অসংখ্যে নক্ষত্রে ছেয়ে আছে আকাশ। যেন মনে হচ্ছে আকাশে বুঝি কেও ঝাড় বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে।দুজনে গল্প করতে করতে ফিরে এলাম রিসোর্টে।আজ রাতের খাবারটা একটু ব্যতিক্রম। বাশের মধ্যে স্পেশাল পদ্ধতিতে মুরগী রান্না করা হয়।মারাত্মক ঝাল এই খাবারটা ভারী মুখরোচক। তবে আমি বেশি ঝাল খেতে পারিনা বলে আমার খাওয়ায় অপূর্ণতায় রয়ে গেলো।আখি খেতে খেতে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো আচ্ছা মারুফ এরা সব ক্ষেত্রেই এতো বাশের ব্যবহার করছে কেন?বললাম,বাশ এদের কাছ সব থেকে সহজলভ্য জিনিস।আসবাপত্র থেকে শুরু করর সব ক্ষেত্রেই এরা বাশের ব্যবহার করে আসতেছে বহুকাল আগে থেকেই কারন এদের কাছে বাশের বিকল্প অন্যেকিছু নেই।এরা বাশের যত ব্যবহার করে আমরা তার সিকি অংশও করতে পারিনা।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে  আবারো চলে গেলাম সূর্যদয় দেখতে।এবার হেলিপ্যাডে না উঠে তার পাশেই আর্মি ক্যাম্পের পার্কে চলে গেলাম। ভিতর টা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা।বেশ কয়েকটা দোলনা আছে।আখি দৌড়ে চলে গেলে দোলনার কাছে।ও দোলনায় বসে ছোট বাচ্চার মতো দোল খেতে লাগলো। কি মিষ্টিই না লাগছে ওকে।মৃদুভাবে ভাবে হেসে দিলাম ওরে দেখে।প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে একটা শিশু বাস করে মাঝে মাঝে সেটা বেরিয়ে আসে।
-এই মারুফের বাচ্চা! দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি দেখিস হ্যা?
-তোরে দেখতেছি..!
-আমাকে দেখার কি আছে?হুম?
-তুই এসব বুঝবিনা!
-আমার এতো বুঝতে হবেনা!তুই এদিকে আয়। দোলনায় দোল দিবি....
-আখি ওইযে আকাশের দিকে তাকা একবার..
আজ মনে হয়  মেঘ গুলো বিদ্রোহ ঘোষণা  করেছে।এতো সারি সারি জমাট বাধা মেঘ যে দেখতে পারবো তা জীবনেও কল্পনা করতে পারিনি। ওই পার্কে সকালটা কাটিয়ে রুমে ফিরে আসলাম।আঁখি তো আসতে চাইছিলো না।ও দোলনায় বসে বসে মেঘ দেখবে...।সকাল ১০ টা বাজে, নাস্তা সেরে গুছিয়ে পড়লাম আর কিছুক্ষণ পড়েই ছেড়ে যেতে হবে সাজেক। কিছুতেই যেতে ইচ্ছা করছিলো না মনে হচ্ছিলো যেন থেকে যাই।যাওয়া কথা শুনেই আখি মন খারাপ করে বসে পড়লো।মেঘের রাজ্যের মায়াজালে আমরা আটকা পড়েছি,কিন্তু যেতে তো হবেই।আঁখির চোখ ছলছল করছে,ওরে বুঝিয়ে রাজি করালাম।আমার নিজেরও অনেক খারাপ লাগতেছে সাজেক ছেড়ে যেতে। ১০:৪৫ এ আমাদের চাদের গাড়ি যাত্রা শুরু করলো রাঙামাটির উদ্দেশ্য।গাড়ি চলেছে ছলছল দৃষ্টিতে আঁখি চেয়ে আছে সাজেকের দিকে।কিছুক্ষণ পরেই ও স্বাভাবিক হলো..মামাকে বলে চাদের গাড়ির সাদে উঠলাম যদিও রিক্সি তবে রাস্তার সৌন্দর্যটা পুরাপুরি উপভোগ করা যায়।আঁখির ও অনেক ভালোলাগবে তাই ওরে নিয়ে সাদে উঠে বসলাম।গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। গাড়ি এবার ব্যাপক ঢালু পথ বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো।যাওয়ার সময় গাড়ির ভিতর ছিলাম আর উপরের দিকে উঠতেছিলাম তাই বুঝতে পারিনি কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।রোমাঞ্চে গায়ে শিহরণ জাগাচ্ছে।গাড়ি একবার স্লিপ করলে হাজার ফুট নিচে খাদের মধ্যে পড়ে যাবে।যেন ড্রাইভারের হাতের মুঠোয় আমাদের জীবন।আখি ভয়ে চোখ বন্ধ করছে মাঝে মাঝে।এক হাত দিয়ে ওরে শক্তকরে ওরে ধরে রেখেছি পরে যাওয়ার চান্স নেই।আঁকাবাকা পাহাড়ি পথে নামতে নামতে চোখে পড়ছে কিছু বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি ঘরবাড়ি,বাজারে হুক্কা টানা অবস্থায় বসে থাকা পাহাড়ি লোকজন আরোও কত কি.....!

৮. দুপুর ১ টার দিকে আমরা দিঘিনলা পৌছালাম।দুপুরের লাঞ্চ সেরে একদল পর্যটকের সাথে  রিসাং ঝর্ণা দেখতে বেরিয়ে পড়লাম।রিসাং ঝর্ণার সৌন্দর্য অন্যেরকম।হাজার ফুট উঁচু থেকে ঝিরঝির করে সাদা পানির স্রোতধারা বেরিয়ে এসেছে।কালো কুচকুচে পাহাড়ের গা বেয়ে পানি পড়তেছে। ঝর্ণার শব্দে যেন সবাই সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছি...ঝর্ণার ঠান্ডা  পানিতে হাত পা ধুয়ে নিলাম।আঁখি কিছু সাদা সাদা পাথর কুড়ালো।পাথর গুলো বেশ সুন্দর আর চকচকে।ঝর্ণার পানির নিচে এমন অনেক সুন্দর সুন্দর নুড়ি পাথর জমে,যেগুলা ঝর্ণার পানিকে বিশুদ্ধ করে।মহান আল্লাহর তৈরি প্রাকৃতির ফিল্টার হলো এই ছোট ছোট পাথর গুলো।আমিও কিছু পাথর কুড়িয়ে দিলাম ওরে।আঁখিরে বললাম এডভেঞ্চার করতে চাস??এডভেঞ্চারের কথা শুনেই ও খুশি লাফ দিয়ে উঠলো।ও এডভেঞ্চার খুব পছন্দ করে তবে সেটা বইয়ের পাতায়।আজ ওকে বাস্তবে অল্পকিছুটা এডভেঞ্চারের স্বাদ পাইয়ে দিবো তাই ঠিক করলাম আলুটিলা গুহাতে যাবো..। রিচাং থেকে পর্যটক দল সহ আমরা চলে গেলাম আলুটিলা গুহাতে।২০ টাকা করে টিকেট আর ১০ টাকায় মশাল  কিনে  রওনা দিলাম আলুটিলার ভিতরে।এই গুহার এক মাথা দিয়ে ঢুকে অন্যে মাথা দিয়ে বের হওয়া যায়।ওই মশালের আলোতে কিচ্ছুই দেখা যায়না বাধ্যে হয়ে মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালাতে হলো।এই গুহাতে ঢুকে কিছু সময়ের জন্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম আদিম যুগে।সুনশান নিরব এই পরিবেশ।একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। পায়ের নীচে শীতল পানির ছোঁয়া। ভুল পথে হারিয়ে যাওয়া প্রবণতা আছে এই গুহার মাঝে।তাই খুব সবাধানে এগুচ্ছি আমরা।অন্ধকারে কারো চেহারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছেনা।আমি আঁখির হাত শক্ত করে ধরি আছি যেন হারিয়ে না যায়।হঠাৎ খেয়াল করলাম আঁখির হাত আমার হাতের মধ্যে নেই।পিছনে ফ্লাশ ধরে দেখি ও নেই। মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো আমার।কোথায় হারিয়ে ফেললাম ওকে।এদিকে পর্যটকদল ছাড়িয়ে গেছে।আঁখি! আঁখি! বলে ডাকতে লাগলাম।গুহার গায়ে শব্দের প্রতিধ্বনি হতে লাগলো।আমার মাথা যেন কিছুতেই কাজ করতেছেনা।গুহায় অন্যে অন্যে মুখগুলোতে খুজতে লাগলাম ওকে।খেয়াল করলাম কে যেন টর্চ জ্বালিয়ে আসতেছে।আঁখি বলে ডাক দিতেই দেখলাম টর্চ নাড়াচ্ছে বুঝলাম হারামিটারে আমি হারাইনি।চোখ ভিজে গেছে আমার,বকা দিতে পারলাম না। ওরে ফিরে পেয়ে মনে হলো দেহে প্রাণ ফিরে এসেছে। 
-কই হারাই গেছিলি কুত্তা!
-হারাই যাইনি তো!আমার পাথরে পলিথিন টা পড়ে গেছিলো আর পাথর সব পরে গেছে।সেগুলাই কুড়াচ্ছিলাম।
-আমারে ডাকবিনা তুই?
-তুই তো চলে গেলি!তাকিয়ে দেখি তুই গেছিস!আর ভাবলাম বেশি সময় লাগবেনা একটু জোরে হাটলেই তোরে ধরতে পারবো!
-তাইলে দেরি করলি যে?
- আমি রাস্তা ভুলে গেছিলাম!
তুই আমারে ছেড়ে গেছোস বান্দর। 
-হইছে আর ঝগড়া করতে হবেনা।চল!চল!
এবার শক্ত করে ধরে রাখবো দেখি কেম্নে হারিয়ে যাস তুই.........
গুহাটি বেশি বড় না,১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই গুহার এ মাথায় পৌছে গেলাম আমরা। বেলা ভালোই হইছে,ক্ষুধায় পেট চো চো করতেছে!আর আর এখানে দেরি না করে সোজা রাঙামাটির উদ্দেশ্যর রওনা দিলাম।তাছাড়া রাঙামাটির সেই ঝুলন্ত ব্রীজ আর আর কাপ্তাই লেক না দেখলে যেন সব বৃথা।
দেড়টার টার মধ্যেই পৌছে গেলাম রাঙামাটিতে। দুপুরের খাবার খেয়ে স্বপ্নচারী রিসোর্টের দিকে গেলাম।রাঙামাটির রিসোর্ট গুলো অনেক সুন্দর বাংলো বাড়ির মতো।
রাঙামাটিতে আমার পরিচিত অনেকেই আছে তাই রিসোস্ট পেতে কোনো বেগ পহাতে হয়না।আখি অবাক হয়ে প্রশ্নোত্তর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!আমি মুচকি হেসে বললাম,আজ কোথাও যাচ্ছিনা,রাঙামাটি  থাকবো!ম্যাডাম আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?ও তাকিয়েই রইলো আমার দিকে।
 ওর চোখের ভাষাতে আমি উত্তরটা বুঝে নিয়েছি।চোখের ভাষা ধরতে পারি আমি...

৯.আঁখি রীতিমত সাইপ্রাইজ!ও ভাবতেই পারেনি আমরা রাঙামাটিতে স্টে করবো।আর এতো সুন্দর রিসোস্টে থাকবো তাও কল্পনা করেনি।আমি জানতাম ও সারপ্রাইজ হবে তাই ইচ্ছে করেই করেই আমি ওরে জানাইনি কিচ্ছু।আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলাম।বিকাল হয়ে গেছে আখিরে বললাম নৌকায় চড়বি? কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ নীল জলে যদি আমার সাথে নৌকায় উঠতে চাস তাইলে দ্রুত রেডি হয়ে আয়! আমি রিসোর্টের ওয়েটিং রুমে আছি।কিছুক্ষণ পর এসএমএস দিয়ে বললো তুই লেকের কাছে যা আমি আসতেছি বেশি সময় লাগবেনা।রিসোর্টে থেকে লেক একদম কাছেই।একটু হাটলেই লেকের পাড়।তাই আর দেরি না করে লেকের পাড়ে চলে আসলাম।বিকাল হয়ে গেছে প্রায়।হারামিটার খোজ নাই।আল্লাই জানে করছে টা কি?২০ মিনিট হলো ঠায় দাড়িয়ে আছি।ওরে আরেকটা এসএমএস করে নৌকা ঠিক করলাম।ছোট্ট নৌকা, সন্ধ্যা অবধি ঘুরবো লেকের মাঝে।নৌকায় বসে আছি আছি একা একা,আর ভাবতেছি আসুক আগে দুষ্টুটা, বকা দিবো!আসি বলে এতোক্ষণ ওয়েট করানোর কোনো মানে হয়?।হঠাৎ খেয়াল করলাম নীল শাড়ি পড়ে কে যেন আমার দিকেই আসতেছে!নীল শাড়ি আমার অনেক পছন্দের।নীল শাড়িতে মনে হয় যেন হিমুর সেই মায়াময়ী রুপা। ওমা!আঁখি! হ্যা আঁখিই তো!!না না!ভুল দেখতেছিনা আমি! বড় ধরণের ধাক্কা খেলাম, মাথায় মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,কিভাবে সম্ভব এটা?আঁখি মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
-কিরে ভ্যাবলার মতো চেয়ে আছিস কেন?
-এটা কি সত্যিই তুই?আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা!!
-আমি নইতো কে??
-তুই শাড়ী পেলি কই??এতো কিছু কখন ম্যানেজ করলি?
-আরে বুদ্ধু তুই কি একাই সারপ্রাইজ দিতে পারিস?? আমি পারিনা বুঝি???
কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি আমি। মামা নৌকা ছেড়ে দিয়েছে।স্বচ্ছ কাঁচের মতো নীল পানিতে নৌকা ধীর গতিতে বেয়ে চলছে..।অপরুপ লাগছে আঁখিকে।নীল শাড়ি,কপালে ছোট্ট টিপ, এলোমেলো চুল গুলোকে এক পাশে সিঁথি করে রেখেছে সুন্দর করে..আর হাতে পড়েছে নীল কাচের চুড়ি ।যেন এক নীল অপ্সরী স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওর পানির ছিটায় যেন আমার সম্মোহন কাটলো।
আঁখি ডাকলো-
 এই যে,ড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন?কি দখছিস এতো?
-তোরে দেখতেছি!মনে হচ্ছে যেন জলপরীর সাথে বসে আছি!
-বাব্বাহ্!হইছে হইছে! আর কবিতা বুণতে হবেনা হিমু সাহেব।না না ভন্ড হিমু একটা!হাহাহা
-আমাকে ভন্ড হিমু বানানোর জন্যে অপরাধী হিসাবে তোকেই দায়ী করবো আমি...যোগী ঋষীদের ধ্যান ভঙ্গ করতো সুন্দরী রমনীরা আর আমি তো তুচ্ছ হিমু মাত্র..
-হইছে, হইছে আর ঢং করতে হবেনা।
হয়ত ও কখনো বুঝবেই না কতটা মুগ্ধ হয়েছি আমি।ও আমাকে এতো বড় সারপ্রাইজ দিবে কল্পনাও করতে পারিনি...!
মুগ্ধ হয়ে আনমনে  প্রকৃতি দেখছে ও।সূর্যের লাল আভা প্রতিফলিতে হচ্ছে লেকের পানিতে।রক্তবর্ণ পানিতে ভাসছে আমাদের ছোট্ট নৌকা।একবার প্রকৃতি দেখছি একবার ওকে দেখছি।যেন দুই সৌন্দর্যের মাঝে প্রতিযোগিতা চলছে..একজন আরেকজনের থেকে একবিন্দু কম নয়।পানির ছালাৎ ছালাৎ শব্দে ভেসে চলেছি,লেকের মৃদু হাওয়া গায়ে লাগছে,আর ও তাকিয়ে দেখছে পাহাড়ে বুকে সূর্যের অন্তিম হয়ে যাওয়া....
তোমার খোলা হাওয়া
লাগিয়ে পালে
টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দিশাহীন চোখে খুজে যাই

হায়রে জীবন আর তার কঠিনতম বাস্তবতা....

ভালোবাসা ভালোলাগা এক নয়