"উত্তম-মধ্যম"


বাপ বেটার প্রতিযোগীতা
.
সবে মাত্র পরীক্ষা শেষ করিয়া বাসা আসিয়াছি, অমনি
দেখি বাপ জান দরজার সামনে হাজির, তাঁহাকে দেখা
মাত্র মুচকি একখান হাঁসি মারিয়া দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে
তিনিও আবুল মার্কা হাঁসি একখান মারিয়া বলিলেন,
বাজান খুশি
খুশিই তো দেহি লাগতাছে, পরীক্ষায় তো
তাইলে মনে অয় ভালোই হইছে।
.
তাহার কথা শুনিয়া আবারও একখান ফকলা হাঁসি দিয়া
বলিলাম,
ড্যাডি, আপনি আমাকে এই প্রশ্ন করিতে পারিলেন?
আচ্ছা, আপনার এই স্বনামধন্য ছাত্র তাহার জীবনে
সবচেয়ে ভালো পরীক্ষা দিয়া সর্বচ্চো কত
নাম্বার পাইয়াছিল?
.
বাজান এবার এদিক ওদিক চাহিয়া ছোট্র একখান কাঁশি
দিয়া
বলিলো, আমার তো বাজান মনে নাই , আপ্নেই
কন।
.
জানতাম, আমি জানতাম আপনি ভুলিয়া যাইবেন। বয়স
তো
আর কম হইলো না। যাইহোক আমিই বলিতাছি, আপনার
এই স্বনামধন্য পুত্র তাহার জীবনে সবচেয়ে
ভালো পরীক্ষা দিয়া সর্বচ্চো নাম্বার পাইয়াছিলো
৩৯, তাও আবার বাংলায়।
.
বাজান আমার কথার মাঝে বা-হাঁত হান্দাই দিয়া
আবারও
এভারেষ্ট জয় করার মত হাঁসি দিয়া বলিলেন, ওহ হ হ
এইবার মনে পড়ছে, মনে পড়ছে। তয় হে তো
মিলা আগের কতা তাই মনে আছিলো না।
.
আমি বলিলাম, ড্যাডি, আপনার এই স্বনামধন্য পুত্র
বাংলায়-ই
যদি সর্বচ্চ নাম্বার ৩৯ পাইয়া থাকে। তা-ইইলে আইজ
পরীক্ষা আছিলো কেমেস্ট্রি, আর জীবনের
সবচেয়ে খারাপ পরীক্ষা আইজই হইয়াছে। তা-
হইলে আপুনিই চিন্তা করিয়া দেখেন, পরীক্ষা
কেমন হইয়াছে।
.
আর যাই হোক, বাজান আমার ছাত্র হিসাবে এমনিতে
খুব ভালো। অল্পতেই অনেকখানি বুঝিয়া ফালায়, তাই
তিনি আর কোন কথা না বলিয়া, মুখটা ঘুরাইয়া চুপচাপ
দরজার সামনে থাইকা চলিয়া গেলেন। তার এই নিরবে
চলিয়া যাওয়ার সাথে আমি খুবই পরিচত। সাথে সাথে
তাই
প্যান্টটা হাটু পর্যন্ত তুলিয়া, স্যান্ডেল হাঁতে নিয়া
আরাম
করিয়া খাটের উপর বসিলাম।
.
খুব তারাতারিই বাপ বেটার দৌড় প্রতিযোগিতা
অনুষ্ঠিত
হতে যাইতেছে তা বুঝিতে আর বাকি রহিলো না।
এই ফাঁকে তাই একটু আরাম কইরা বইসা বিশ্রাম না
নিলেই
নয়।
.
না, বিশ্রাম নেওয়াটা আর বুঝি হইলো না। ইতিমধ্যেই
মায়ের ডাক কানে ভাঁসিয়া আসিতো লাগিলো। তিনি
চিৎকার কইরা বলিতেছেন, অর্নব পালা বাপ, পালা,
তোর বাপ লাঠি লইয়া যাইতেছে, ঘর থাইকা বাহির হ
তারাতারি।
.
দেড়ি না করিয়া খাট থাইকা লাফ মারিয়া নাইমা
দৌড় দিবো,
অমনি দেখি বাজান দরজার সামনে সালমান খান
স্টাইলে
কোমড়ে হাত দিয়া দাড়াইয়া রহিয়াছেন । পিছনে
ক্যার্টিনা কাইফের স্টাইলে আমার আম্মাজান।
তাহাকে
বাজান হাঁত দিয়া ঠেলিয়া ধরিয়া রহিয়াছে, যাতে
ঘরে
ঢুকিতে না পারে।
.
বাজানের হাঁতে ইয়া মোটা লম্বা বাঁশ। ধরিতে পারিলে
এই বাঁশ আমার পিঠে ভাঙিয়া ছোট করা হইবে বুঝিলাম।
অতঃপর বাঁশের সাইজ দেখিয়া ডরে কান্নার জায়গায়,
ভুল করিয়া হাঁসিয়া দিয়া বলিলাম "ড্যাডি" আপুনি কি
এই বাঁশ দিয়া
আমাকে "উত্তম-মধ্যম" করিতে আসিয়াছেন?
.
বাজান ভনিতা করার ভঙ্গিতে বলিলেন, এসব কি বলেন
আব্বাজান?, আপুনি আমার এক মাত্র আদর্শবান পুত্র
বলে কথা, আপুনাকে কি আমি উত্তম-মধ্যম করিতে
পারি বলেন?
.
আমি এবার এক হাঁতে স্যান্ডেল ধরিয়া, অন্য হাঁত মুখে
দিয়া আঙ্গুল নাঁচাইতে নাঁচাইতে চিন্তা করার ভঙ্গিতে
বলিলাম, কিন্তু "ড্যাডি" আমার কাছে আপুনার ভাব-
কায়দা
তো ভালো ঠেকিতেছে না। আপনু কি যেন
একটা করিতে চলিতেছেন।
.
বলিতে না বলিতে বাজান আমার বাঁশ লইয়া আমার
দিকে
সজরে তেরে আসিলেন। বাপের স্বনামধন্য পুত্র
বলে কথা, আমিও দেড়ি না করিয়া ঘরের পিছনের
দরজার দিকে দিলাম ভৌ দৌড়। এক দৌড়ে ঘর থাইকা
বাহির
হইয়া দেয়ালের কাছে গিয়া, দিলাম এক লাফ।
.
ভাগ্যের পরিহাস, অমনি পা পিছলাইয়া ব্যাঙের মত চার
হাঁত
পা ছড়াইয়া চিৎ পটাং হইয়া মাটিতে লুটিয়া পরিলাম।
সেইরকম
ব্যাথা পাইলাম কোমড়ে। এই ব্যাথার কথার কথা চিন্তা
করিলে এরূপ হাজারো ব্যাথা আমার জন্য অপেক্ষা
করিতেছে, ব্যাথার কথা তাই ভুলিয়া গিয়া আবার
উঠিয়া লাফ
মারিলাম। কাজ হইলো না। তৃতীয় বারের মাথায় সফল
হইলাম। দেয়ালের উপাশে গিয়া কোমড় ডলিতে
ডলিতে বাজানের উদ্দেশ্যে বলিলাম, "ড্যাডি"
দেয়াল অনেক উচু। আপুনি উঠিতে পারিবেন না, কষ্ট
হইবে। আপুনি বরং গেইট দিয়ে বাহির হইয়া আসেন,
আমি আপুনার জন্য গেইটের সামনে অপেক্ষা
করিতেছি, এক সাথেই দৌড় শুরু করবো।
.
আর আম্মাজান আপুনি কিন্তু রেফারি। কোন প্রকার
দুই নাম্বারি করিবেন না। আমি আপুনার পুত্র আর উনি
আপুনার স্বামী সুতরাং দুইজন কিন্তু সমান। দল টানিবেন
না মোটে। (ওরে..দিলো..দিলো..সর..সর)
চিৎকার শুনিয়া পিছনে ফিরিয়া চাহিলাম। ও আল্লাহ,
এ কিডা?
হায় হায়, এতক্ষন তা-হইলে কাদের এত কথা বলিলাম?
বাজান দেখি আমার প্রায় কাছে চলিয়া আসিয়াছেন।
হাঁতে চিরচেনা সেই মোটা বাঁশ।
.
সময় না লইয়া বিদ্যুৎ গতিতে আবার ছুটিলাম। আমি
দৌড়াই,
বাজানও দৌড়ায়। আমিও দৌড়াই, বাজানও দৌড়ায়।
দৌড়ে আর
থামাথামি নাই। সেইরকম প্রতিযোগিতা চলিতেছে।
আমি দৌড়াইতেছি বাঁচার উদ্দশ্যে, আর বাজান দৌড়ায়
মারার
উদ্দেশ্যে। সুতরাং এই প্রতিযোগিতায় আমার জিতাটই
অত্যাবশ্যক। জীবন মরনের প্রশ্ন বইলা কথা।
.
কিন্তু বাজান তো সুপারগুলু আঠার মত পিছনে লাইগা
রহিয়াছে। যে করেই হোক এরে কাটাইতে
হবে। অতঃপর অনেক কষ্টে বাজানরে তিন চারটা
ঘুরান্ট্রি মারিয়া চিপাচাপা গলিতে ঢুকিয়া পড়িয়া
এক বিল্ডিংয়ের
পাশে গিয়া দাড়াইলাম। সেইরাম হয়রান হইয়া গিয়াছি।
কুকুরের মত জিহ্বা তিন হাত বাইর হইবার মত অবস্থা।
পানিও নাই আশে পাশে কোথাও।
.
গর্ত থাইকা ইন্দুর বাইর হইলে যেমন মাথা বাইর কইরা
আশেপাশে দেখে কেউ আছে কিনা, ঠিক একই
স্টাইলে মাথাটা বিল্ডিংয়ের আড়াল থাইকা বাহির
কইরা
আশেপাশে ভালো কইরা দেখিয়া নিলাম, আজরাঈলটা
কোথাও আছে কিনা।
.
না, কোথাও দেখা যাইতিছে না, সুতরাং নির্ভয়ে
বাহির
হওয়া যায়। এবং বাহিরও হইলাম। হাটার মত শক্তি
পাইতেছি
না পায়ে। অন্যদিকে কোমড়ের ব্যাথা। তবুও
হাটিতে লাগিলাম। কোথায় যাবো চিন্তা করিতেছি।
দুই
চার দিনের ভিতর বাড়ির কথা ভুলেও মুখে উচ্চারন করা
যাইবে না। সুতরাং এই সময়টা খালার বাসায়
বেড়ানোটাই
উত্তম মনে করিলাম।
.
যে কথা সেই কাজ, হাঁটার মোড় ঘুরাইয়া গাড়ির
স্টান্ডের দিকে হাঁটিতে লাগিলাম। একটু খানি
হাটিতেই
পিছন থাইকা পরিচিত সেই মধুর কন্ঠ কানে ভাসিয়া
আসিলো, ঐ হারামি খারা কইতাছি, খারা, খারা।
.
পিছনে আর চাইবার সময় কই। আগের মত আবার
হাওয়ার গতিতে ছুটিয়া চলিলাম আর চিৎকার করিয়া
বলিতে
লাগিলাম "ড্যাডি" আমারে তো আর পাগলা কত্তায়
কামড়ায় নাই যে আপুনার কথা মত খারামু। বরাবরে মত
আইজও আমিই জিতুম। আপুনি বরং বাড়ি দিকে পথ
মাপেন, আপুনার কষ্ট আমার সহ্য হইতাছে না।
.
অতঃপর বাজানও চিৎকার করিয়া বলিলো, তোরে
পামুরে, তোরে পামু আমি। হাতের কাছে পাইলেই
বুঝামু।
.
তাহার কথায় আর কান না দিয়া, এক দৌড়েই স্টান্ডের
গিয়া
গাড়িতে উঠিয়া চলিয়া গেলাম খালার বাসায়। সাত
দিনের দিন
খালার বাসায় থাকিবার পর আমার আদরের "ড্যাডি"
নিজেই
ফোন করিয়া বলিলেন, ঐ বাড়ির পোলা বাড়ি আয়,
তোর মা চিন্তা করিতাছে।
.
আমি বলিলাম "ড্যাডি" আপুনি আগে প্রোমিজ করেন
বাড়িতে আদর করিয়া ডাকিয়া নিয়া উত্তম-মধ্যম
দিবেন না
তো আবার?
.
বাজান কহিলো, আচ্ছা আয় কিছু বলিবো না। শুধু একটা
চটকানা (চড়) দিমু ওয়াদা করিলাম।
.
আমি কহিলাম, আবার চটকনা ক্যা?
.
বাজান বলিলেন, এতটা দৌড়ানি দৌড়ালি আমারে
দিয়া, একটা
চটকনা না দিলে ভালো লাগবো নারে বাপ।
.
আমি বলিলাম, আইচ্ছা তাইলে ঠিক আছে, তয় একটাই
কিন্তু এর বেশি জানি না হয়।
.
বাজান বলিলেন, হ একটাই। এর বেশি হইবে না।
..
অতঃপর সাতদিন উত্তম-মধ্যমের ভয়ে খালার বাসায়
বেড়াইয়া, এক চটকনার কন্ট্রাক করিয়া বাড়ির
স্বনামধন্য
পুত্র বাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দিশাহীন চোখে খুজে যাই

হায়রে জীবন আর তার কঠিনতম বাস্তবতা....

ভালোবাসা ভালোলাগা এক নয়